দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রাক চালকদের মাধ্যমে এইডস রোগের বিস্তার
৫ জুলাই ২০১১জনসন এনডেন্ডে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন৷ তার বয়স৫৮ বছর৷ ট্রাকচালক তিনি৷ রক্তচাপ, ডায়বেটিস বিশেষ করে এইডস 'এর পরীক্ষা করাতে হবে তাঁর৷ ১৮ মিটার দীর্ঘ এক ট্রাক চালান তিনি৷ ডাক্তারের প্রয়োজন হলে তিনি ট্রাকচালকদের জন্য নির্দিষ্ট ক্লিনিকে যান৷ পার্কিং'এর জায়গার কাছাকাছি থাকে এই সব ক্লিনিক৷ জনসন জানান, ‘‘আমার হাসপাতালে গিয়ে চিকিত্সা করার সুযোগ নেই৷ দিনের বেলায় সেখানে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়৷ অন্যদিকে ট্রাকচালকদের ক্লিনিককে দারুণ বলা যায়৷ এই সব ক্লিনিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় খোলে৷ তাই সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়৷ ৮টা থেকে আমাদের কাজ শুরু করতে হয়৷''
দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাকচালকদের মধ্যে এইডস-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি৷ তুলনামূলকভাবে তাঁদের আয় বেশি৷ বাড়ি থেকে দূরেও থাকতে হয় তাঁদের প্রায়ই৷ এসব কারণে অনেকেই যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে আসেন৷
জনসনের আজ বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি ক্লিনিকে৷ প্রথম কয়েকজন রোগীর মধ্যেই ছিলেন তিনি৷ ক্লিনিকের দেয়ালে পোস্টার লাগানো, যাতে এইডস সম্পর্কে নানা রকম তথ্য পাওয়া যায়৷ এক কোণে একটি টেলিভিশন৷ একটি কনটেইনারে ট্রাকচালকদের ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে, তাই খুব বড় নয় এটি৷ দ্বিতীয় ঘরটিতে চিকিত্সা করা হয়৷
নার্স মাসাপাপু একজন ট্রাকচালকের রক্ত নিচ্ছেন পরীক্ষার জন্য৷ তিনি বলেন, ‘‘যে সব ট্রাকার আমাদের কাছে আসেন, তাদের অধিকাংশই ভয় পাননা৷ আমরা থাকায় তাঁরা খুশি৷ তাদের বড় কোনো হাসপাতালে যাওয়ার সময় নেই৷ সেজন্য আমাদের কাজকর্ম প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন তাঁরা৷''
দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রাকারদের ক্লিনিক এইডস মহামারির বিরুদ্ধে এক সাফল্য৷ দেশটির পাঁচ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০ লাখের বেশি মানুষ এইডস-এর ভাইরাসে সংক্রমিত৷ এর মধ্যে অনেকেই ট্রাক চালক৷ জ্বালানি তেল নিতে বা রাত কাটানোর জন্য তাঁদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেতে হয়৷ অনেকে আবার এই ফাঁকে যৌনকর্মীদের কাছেও যান৷ ফলে এইডস রোগের বিস্তার হচ্ছে দ্রুত গতিতে৷
সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই রকম ২০টি ক্লিনিকের দায়িত্বে রয়েছেন টেরেটিউস ভেসেল্স৷ তিনি জানান, সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মালিক পক্ষ ও শ্রমিক সমিতিগুলি তাদের ঝগড়া বিবাদ ভুলে গিয়ে এক টেবিলে বসে এইডস-ক্লিনিক প্রকল্প গড়ে তোলেন৷ জার্মান গাড়ি কোম্পানি মের্সেডিস বেঞ্জ দক্ষিণ আফ্রিকার এই প্রকল্পকে সাহায্যের জন্য নিজেদের গাড়ি দিয়ে মোবাইল ক্লিনিক চালু করে৷ টেরটিউসের ভাষায়, ‘‘৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ মালামাল ট্রাকের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়৷ প্রায় ধসে পড়া রেল ব্যবস্থার কারণে ট্রেনে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাল নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তাই গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চালু রাখার জন্য ট্রাকচালকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সারা দেশে ৭০ হাজার ট্রাকচালক মাল পরিবহনের দায়িত্বে রয়েছেন৷ তাদের ছাড়া অর্থনীতির এই শাখাটি অচল হয়ে পড়তো৷''
নার্স মাসাপাপু জানান, আপনার রক্তচাপ ঠিক আছে৷ জনসন কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করে নেন৷ সপ্তাহ তিনেক পরে কেপটাউনে একটা ট্রিপ নিয়ে এলে এইডস পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারবেন তিনি৷ আজ তাঁকে ৭০০ কিলোমিটার দূরের শহর পোর্ট এলিজাবেথে যেতে হবে৷ সঙ্গে থাকবেন সহকর্মী ননোপেডি জ্যাকবসন, যাকে বহু দিন ধরেই চেনেন তিনি, পছন্দও করেন৷ বেশির ভাগ সহকর্মীদের সঙ্গেই খাপ খায়না তাঁর৷
ননোপেডি বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ট্রাকচালকই কনডোম ব্যবহার করতে পছন্দ করেননা৷ কাজ শেষ করার পর কিছু পান ও আনন্দ স্ফূর্তি করতে চান তাঁরা৷ কনডোমের ব্যাপারটা গুরুত্ব পায়না তাঁদের কাছে৷ এইডস-এর কথা শোনার পর থেকে আমি আর ও মুখো হইনি৷ আমার জীবনে এখন একজনই নারী আর তিনি হলেন আমার স্ত্রী৷''
ননোপেডির মত ট্রাক চালকরা মাসে ৩০০ ইউরোর মত উপার্জন করেন৷ দারিদ্র্য জর্জডরিত যে সব এলাকায় তাঁরা যাত্রা বিরতি করেন, সেখানে এটা প্রচুর অর্থ৷ অনেক সময় পেটের দায়ে দেহ ব্যবসায়ে আসা মেয়েদের জন্য কোনো অর্থও ব্যয় করতে হয়না৷ এক টুকরো রুটি কিংবা অর্ধেক মুরগি হলেই পাওয়া যায় তাদের সঙ্গ৷
এইডস রোগকে আয়ত্তে আনার জন্য কয়েক মাস ধরে শুধু ট্রাক চালকদের নয় যৌনকর্মীদের চিকিত্সারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে নিখরচায়, যা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক