করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সেখানে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮৯৩। অন্য দিকে চীনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৬৩। জাপান উপকূলে আটকে যাওয়া প্রমোদতরি ডায়মন্ড প্রিন্সের চতুর্থ যাত্রীর মৃত্যুর খবর মিলেছে। ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে ইরান এবং ইটালিতে। ফের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মঙ্গলবার সকালে চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, নতুন করে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৭১ জনের। তবে গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। যদিও উহান প্রদেশের অবস্থা এখনও ভয়াবহ। অধিকাংশ মৃত্যু সেখানেই ঘটছে। বাকি দেশের থেকে এখনও আলাদা করেই রাখা হয়েছে উহান প্রদেশকে। বাইরের কোনও গাড়িও সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নভেল করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়৷ শুরুতে এর নাম দেয়া হয় ২০১৯-এনসিওভি, পরে কোভাড-১৯৷ বিশ্বজুড়ে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ চীনে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন সহস্রাধিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/SOPA Images/A. Marzo২০১৯ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নতুন এক রোগের কথা জানায়৷ এক কোটিরও বেশি মানুষের উহান শহরে অনেকেই শ্বাসতন্ত্রের অজানা সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে৷ রোগের কারণ ও ধরন অজানা৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন৷ শহরের সামুদ্রিক খাবারের বাজার দ্রুত বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ শুরুতে কেবল ৪০ জনের মতো আক্রান্তের খবর এসেছিল৷
ছবি: Imago Images/UPI Photo/S. Shaver২০০২ সালে চীন থেকেই ছড়িয়েছিল আরেক করোনা ভাইরাস- সার্স৷ সার্সে বিশ্বজুড়ে আট শতাধিক মানুষ মারা যান৷ শুরুতে এই ভাইরাসকে সার্স মনে করলেও পরে ৭ জানুয়ারি তারা ঘোষণা করেন, এটি মানুষের অজানা সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস৷ সার্স এবং সাধারণ ঠান্ডা-কাশির মতো এটিও করোনা ভাইরাস পরিবারেরই সদস্য৷ এর লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া৷
ছবি: picture-alliance/BSIP/J. Cavallini১১ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে চীন৷ উহানের সামুদ্রিক খাবারের দোকানে এক নিয়মিত ক্রেতা ছিলেন এই ৬১ বছর বয়সি ব্যক্তি৷ শেষের দিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি৷
ছবি: Reuters/Strপরের কয়েক দিনেই থাইল্যান্ড ও জাপানে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ এসব আক্রান্তও উহানের সেই বাজারে গিয়েছিলেন৷ উহানে দ্বিতীয় মৃত্যুর খবর আসে৷ জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়, ২০০ মানুষ আক্রান্ত হন ভাইরাসে৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoonনতুন ভাইরাস কিভাবে একজনের শরীর থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়াচ্ছে, তা বের করতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা৷ করোনা ভাইরাস জুনোটিক, অর্থাৎ, পশু থেকে মানুষে ছড়িয়েছে৷ কিছু করোনা ভাইরাস কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা শুরু হয়৷ জানুয়ারির ২০ তারিখে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, নতুন এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCYজানুয়ারির ২৩ তারিখে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুরো উহানকে কার্যত বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়৷ শ্রমিকরা দ্রুত হাসপাতাল তৈরি করা শুরু করেন৷ জানুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়, আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩০ জনে৷ উহানের পাশাপাশি আরো ১২টি শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ এর প্রভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সাড়ে তিন কোটি মানুষ৷
ছবি: AFP/STRচীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং তাইওয়ানেও ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যেতে থাকে৷ আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে৷ কিন্তু জানুয়ারির ২৩ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ‘এখনই’ জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির সময় হয়নি৷
ছবি: Getty Images/X. Chuজানুয়ারির ২৪ তারিখ ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইউরোপে প্রথম করোনা ভাইরাসে একজন আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ করে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অস্ট্রিয়ায় চার জন আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Mortagneজানুয়ারির ২৫ তারিখ চীনা নববর্ষ শুরু হয়৷ তবে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে বড় বড় সব অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ৷ জানুয়ারির শেষের দিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা শহরের সংখ্যা পৌঁছায় ১৭-তে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন পাঁচ কোটি মানুষ৷ মানুষের যাতায়াত কমাতে নববর্ষের ছুটি বাড়ানো হয় আরো তিন দিন৷
ছবি: Reuters/C. Garcia Rawlinsকম্বোডিয়ায় প্রথম ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ চীন সীমান্তে গাড়ি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে মঙ্গোলিয়া৷ রাশিয়া পূর্বাঞ্চলের তিনটি সীমান্ত বন্ধ করে দেয়৷ বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসা ও তেলের দামে ধস নামে৷ বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩০০-তে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪১৷ গবেষকরা তিন মাসের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের আশা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Reuters/C. G. Rawlins২৭ জানুয়ারি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস উহান থেকে জার্মান নাগরিকদের ফেরত আনার ঘোষণা দেন৷ চিকিৎসকরা এর জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানানো হয়৷ জার্মানির মারবুর্গে গবেষকরা এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert২৭ জানুয়ারিতেই জার্মানিতে প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ জার্মানি সফররত চীনা সহকর্মীদের কাছ থেকে বাভারিয়া অঞ্চলের ৩৩ বছর বয়সি এ নাগরিকএ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়৷ মিউনিখের হাসপাতালে তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়৷ পরের দিনই তার আরো তিন সহকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ চীনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩২-এ৷
ছবি: Reuters/A. Uyanik২৮ জানুয়ারি জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহান থেকে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে আনে৷ চার নাগরিককে জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়৷ ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় নতুন এ ভাইরাস, বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হন ৬০০০ মানুষ৷
ছবি: imago images/Kyodo Newsজানুয়ারির ৩০ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশেষে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে৷ তবে সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বাণিজ্য ও পর্যটন সীমিত না করতে দেশগুলোকে আহ্বান জানান৷
ছবি: picture-alliance/KEYSTONE/J.-C. Bottপয়লা ফেব্রুয়ারি ১০২ জন জার্মান নাগরিকসহ ১,১২৪ জনকে উহান থেকে বিমানবাহিনীর বিমানে ফ্রাঙ্কফুর্টে নিয়ে আসা হয়৷ গেরমেরশাইমে সেনা ব্যারেক তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাদের মধ্যে অন্তত দুই জনের ভাইরাস সংক্রমণের খবর মিলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorstউহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদেরও ফেরত নিয়ে আসা হয় ১ ফেব্রুয়ারি৷ বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ৩১২ জনকে আনা হয় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে৷ সেখান থেকে তাদের সরাসরি আশকোনার হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ১৪ দিন পরও তাদের কারো মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ মেলেনি৷
ছবি: A. Goni২ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ফিলিপাইন্সে৷ তবে ৪৪ বছর বয়সি এ ব্যক্তিও চীনা নাগরিক৷ উহান থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি৷ নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয় তার৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Aljibeনতুন করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় উহানে মাত্র ১০ দিনে নতুন হাসপাতাল তৈরি করে তাক লাগায় চীন৷ ৩ ফেব্রুয়ারি চালু হয় দ্য হোশেনশান হাসপাতাল৷ আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধও ব্যবহারের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Imago/L. He৩ ফেব্রুয়ারি জাপান উপকূলে ইয়োকোহামায় প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেস-এ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখের মধ্যে প্রমোদতরীর ৪৫০ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/kyodo১৩ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানায় চীন৷ অবশ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা সংক্রমণের তথ্য জানতে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে৷ আগে কেবল নিউক্লিইক অ্যাসিড পরীক্ষা করা হলেও এখন ফুসফুসের সিটি স্ক্যানও করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য এখন উদ্বিগ্ন দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে। প্রতিদিনই সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বেশ কিছু চার্চ রবিবারের প্রার্থনায় জন সমাগম বন্ধ করে দিয়েছে। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। বেশ কিছু স্কুল আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে।
এ দিকে জাপানেও ছড়াচ্ছে ভাইরাস। জাপানের প্রশাসন জানিয়েছে, ডায়মন্ড প্রিন্সের বহু যাত্রীর দেহেই করোনার সংক্রমণ মিলেছে। ওই জাহাজের চতুর্থ যাত্রীর মৃত্যুর কথাও জানানো হয়েছে জাপানের তরফে। ইরান আরও দুই ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। তুরস্ক, ইরাক, পাকিস্তান নিজের দেশের নাগরিকদের ইরানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। ইরানের সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে।
ইটালির অবস্থাও উদ্বেগজনক। সোমবার সকাল পর্যন্ত সে দেশে ১৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তির শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছিল। মঙ্গলবার ইটালির একটি পত্রিকার দাবি, আক্রান্তের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করেছে, করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে। তবে এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে চীনের সরকার কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। আদৌ সেই ওষুধ ব্যবহার করা যাবে কি না, তাও স্পষ্ট নয়।
এসজি/জিএইচ (রয়টার্স, ডিপিএ, এপি)