বাংলাদেশে দমনের রাজনীতি কবে থেকে শুরু বা কোন সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে? এ নিয়ে বিতর্ক আছে৷ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম মনে করেন, সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরাই৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে : ডাকসু ভিপি নুর তো প্রায়ই মার খাচ্ছে? কেন বারবার তার উপর হামলা?
মোহাম্মদ নাসিম: সে তো ডাকসুর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত ভিপি৷ এই হামলা খুবই দুঃখজনক৷ আজকেও দেখলাম তার উপর যারা হামলা করেছে তাদের দুইজন গ্রেপ্তার হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের মধ্যে এত বেশি অছাত্র, এত বেশি অনুপ্রবেশকারী, যে কারণে প্রায়ই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে৷ এটা খুবই দুঃখজনক৷ এখানে আমার মতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার৷ যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে৷
বাংলাদেশে দমন পীড়নের রাজনীতি কবে থেকে শুরু?
সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হবে, এটা জিয়াউর রহমানের সময় শুরু হয়েছে৷ জিয়াউর রহমানের সময় সামরিক আইন জারি করে বিরাজনীতিকরণের কাজটা উনিই তো করে গেছেন৷ ওই সময় সামরিক আইনের ফলে সন্ত্রাস, ছাত্রদের দিয়ে গুণ্ডামি করানো শুরু হয়৷ যা এরশাদের সময়েও অব্যাহত ছিল৷
এরশাদ শাসনামলে এই ধরনের ঘটনা কেমন ছিল?
সব আমলেই এটা বেশি ছিল৷ এটার ভুক্তভোগী আমরা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা৷ তখন যে পরিমাণ দমন পীড়ন হয়েছে সেটা কল্পনা করা যায় না৷ রাজনীতিকদের দমন করার জন্য এরশাদ-খালেদা জিয়া সব ধরনের পদক্ষেপই নিয়েছেন৷ বলতে গেলে এখনো সেটার ছিটেফোঁটা রয়ে গেছে৷
বর্তমান সরকারের সময় দমন পীড়ন বেড়ে গেছে বলে বলা হচ্ছে?
মোহাম্মদ নাসিম
এখন কিন্তু এমন ঘটনা ঘটলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷ যে ঘটনাগুলো ঘটে সেটা অনাকাঙ্খিত৷ সরকার যখনই জানতে পারে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷ অনেকে গ্রেপ্তার হচ্ছে, অনেককে বহিষ্কার করা হচ্ছে৷ আমাদের সরকারই কোনো ঘটনা ঘটলে দলীয় চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে৷
বিরোধী মতাদর্শের মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন?
এটা ঠিক না৷ বরং আমরা বেশি নির্যাতিত হয়েছি৷ আমাদের নেত্রী কারারুদ্ধ হয়েছেন৷ খালেদা জিয়ার সময় নির্যাতনের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল৷ অনেক নেতা, এমপি খুন হয়েছেন৷ প্রত্যেক নেতাই নির্যাতিত হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাখা হতো৷ রাজনৈতিকভাবে কাউকে দমন করছি, এটা কেউ বলতে পারবে না৷
আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি দমনের রাজনীতি হয়েছে কোন আমলে?
বলতে হলে, সবচেয়ে বেশি দমনের রাজনীতি হয়েছে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আমলে৷ এরশাদের আমলে হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি হয়েছে খালেদা জিয়ার আমলে৷ তখন তো আমাদের নেত্রীসহ সব নেতাকে মারার জন্য গ্রেনেড হামলা হয়েছে৷ তখন তো আওয়ামী লীগের কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি৷
দমনের রাজনীতির শেষ পরিণতি কি?
দমনের রাজনীতি করে কেউ টিকে থাকতে পারেনি৷ এখন গণতন্ত্র আছে, সংসদ আছে৷ কথা বলার অধিকার পরিপূর্ণভাবে আছে৷ মিডিয়ার স্বাধীনতা আছে৷ এখন ইচ্ছেমতো লেখা যায়৷ আমরা প্রত্যেকটা ঘটনার নিন্দা জানাই৷ পাশাপাশি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে৷
কেউই তো নিপীড়ন করে টিকে থাকতে পারেনি৷ তারপরও কেন এই নিপীড়ন?
ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চায়৷ তারা তো প্রশ্রয় পাচ্ছে না৷ দেখেছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বাড়াবাড়ি অনেকেই করতে চায়৷ এটা তো অসম্ভব কিছু না৷ এখনে অনেক বেশি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কি?
রাষ্ট্রের দমন কৌশল
বাংলাদেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা বিরুদ্ধমত দমন করেছে৷ কখনও আইন, কখনও প্রশাসন, কখনও সহযোগী সংগঠনের পেশি শক্তি ব্যবহার করে ভিন্ন মতের মানুষের উপর চালানো হয়েছে নির্যাতন৷
ছবি: Sony Ramany/AFP
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি
সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কিংবা মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটেছে বাংলাদেশে৷ এরশাদের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করে৷ এমন ঘটনা অব্যাহত ছিল গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও৷ ২০০৬ সালে কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গণবিক্ষোভে ২০ জন নিহত হয়েছে৷
ছবি: DW/H. U. Rashid Swapan
মিছিল-সমাবেশে বাধা
নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে রাস্তায় প্রতিবাদে বাধা দেয়৷ চলে পুলিশি হামলা, নির্যাতনের ঘটনা৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে৷ শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় নাগরিক সমাজের প্রতিবাদেও বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ছবি: bdnews24.com
গুম কিংবা নিখোঁজ
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯-১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
মামলার হয়রানি
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
ছবি: bdnews24.com
পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে বরাবরই ব্যবহার করে আসছে বিপক্ষ বা ভিন্নমত দমনে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে এমন পেশিশক্তির ব্যবহার আরও প্রকট হয়েছে৷ ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে৷ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
নিষ্পেষণমূলক আইন
ভিন্নমত দমনে আশ্রয় নেয়া হয় আইনেরও৷ ২০১৫ সালে করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ব্লগার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে৷ সেটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হলে সেখানেও একই ধরনের বিভিন্ন ধারা রাখা হয়৷ এই আইনে আটক হয়ে জেলখানায় বিনা বিচারে মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
গণমাধ্যমের উপর চাপ
বাংলাদেশে এখন বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যম থাকলেও তাদের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয় সরকার৷ মালিকানা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই এখন সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালের ২৯ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, ঐ বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে বাংলাদেশ৷ তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে যে কোনো ওয়েবসাইটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি বড় অর্জন৷’’
ছবি: picture-alliance/chromorange/C. Ohde
ফোনে আড়িপাতা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিভিন্ন মানুষের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে৷ ইউটিউব বা গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, লঙ্ঘন করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা৷
ছবি: imago/avanti
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বিরোধী দলসহ নাগরিকদের প্রতিবাদ ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর হামলা, মামলা এবং বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: AP/DW
11 ছবি1 | 11
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখতে হবে৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যত বেশি শক্তিশালী হবে ততই উত্তরণ ঘটবে৷ অন্য দেশেও এটা হয়৷ এই ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে সবসময়ই পদক্ষেপ নিতে হবে৷ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি৷
বর্তমান সরকারের সময়ে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার সবগুলোতেই কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
সবগুলোতেই নেওয়া হয়েছে৷ বুয়েটের ঘটনা দেখেন৷ নুরের উপর হামলার ঘটনা দেখেন৷ বিলম্ব হতে পারে কিন্তু সব ঘটনাতেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷
এত ব্যবস্থা নেওয়ার পর কেন ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
এটা আমাদের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়৷ এত ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কেন হচ্ছে? তবে উপর পর্যায়ে এখন আর নেই, নিচের দিকে হয়ত আছে৷ আমার মনে হয় ধীরে ধীরে এটা কমে যাবে৷ যারা এটা করছে তারা ছাত্রলীগের নামধারী৷ তারা ছাত্রলীগ করে কিনা সন্দেহ আছে৷
আরো বেশি মনিটরিং দরকার কি-না?
মনিটরিং না হলে ব্যবস্থা নিচ্ছি কিভাবে৷ সরকার প্রধানের এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা আছে৷ আশা করি কমে যাবে৷ না কমলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷