আপাতত স্বস্তি। দলের আস্থাভোটে জিততে খুব বেশি অসুবিধার মুখে পড়তে হলো না যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। তার কনজারভেটিভ পার্টির ৫৪ জন এমপি দাবি করেছিলেন, পার্টিগেটের দায় নিয়ে জনসন ইস্তফা দিন। তাই দলে আস্থাভোট নিতে হয় জনসনকে। তার পক্ষে পড়ে ২১১টি ভোট এবং বিপক্ষে ১৪৮টি। দুই ঘণ্টা ধরে ভোটপর্ব চলে। তারপর ফলাফল প্রকাশিত হয়। আস্থাভোটে জিতে যাওয়ায় বরিস জনসনকে আর এক বছরের মধ্যে দলের ভিতরে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে না।
পার্টিগেট নিয়ে চাপে ছিলেন জনসন। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল, দলের ৫৯ শতাংশ এমপি-র সমর্থন পেয়েছেন তিনি। জনসন জানিয়েছেন, ''এই ভোটের ফল হলো নির্ণায়ক। আমরা এখন প্রশাসনে মনোনিবেশ করতে পারব। মানুষের জন্য যে কাজ করা দরকার, সেই সব কাজ করতে পারব।''
ফলাফলের প্রতিক্রিয়া
অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনক বলেছেন, ''প্রধানমন্ত্রী আস্থাভোট জিতেছেন। এখন এগিয়ে যাওয়ার সময়। কাল থেকেই আমরা কাজে লেগে পড়ব। আর্থিক বৃদ্ধি ও জনসেবার কাজে লেগে পড়ব।''
তবে বিরোধী লেবার পার্টির বক্তব্য, এই ভোট ক্ষমতাসীন দলের বিভাজনকেই সামনে আনল। এর ফলে দলের মধ্যে বিরোধ আরো বাড়বে।
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall কীভাবে ভোট হলো
এই ভোট দিয়েছেন শুধু জনসনের কনজারভেটিভ পার্টির এমপি-রা। পার্লামেন্টের সব সদস্য নয়। তার দলের ১৫ শতাংশ এমপি জনসনের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। ফলে জনসনকে আস্থাভোট নিতে হয়েছে। নিয়মানুসারে দলের ১৮১জন এমপি জনসনের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাকে পদত্যাগ করতে হতো। এই আস্থাভোটে জেতার ফলে জনসনকে তার দলে এক বছরের মধ্যে আর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে না।
তবে দলের আস্থাভোট এবং পার্লামেন্টের আস্থাভোট এক বিষয় নয়। হাউস অফ কমন্সে এরপরেও জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যেতে পারে। তবে সেটা আনতে হবে বিরোধীদের। ক্ষমতাসীন দলের কাছে য়খন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তখন বিরোধীরা সচরাচর অনাস্থা প্রস্তাব আনে না।
পার্টিগেট নিয়ে চাপ
তবে পার্টিগেট নিয়ে জনসনের উপর চাপ থাকছেই। তিনিই প্রথম প্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যিনি ক্ষমতায় থাকার সময় আইন ভাঙার দায়ে জরিমানা দিয়েছেন। করোনাকালে নিয়ম ভেঙে পার্টি করার অভিযোগ যখন সামনে আসে, তখন তিনি প্রথমে বলেছিলেন, পার্টি করেননি। পরে বলেন, তিনি ওই জমায়েতকে পার্টি বলে মনে করেননি। শেষপর্যন্ত তিনি পার্লামেন্টে ক্ষমা চান। তবে তিনি বলেছেন, তিনি পার্লামেন্টে মিথ্যা কথা বলেননি।
আস্থাভোটের আগে জনসন দলের এমপি-দের বলেছিলেন, তিনি ব্রেক্সিট কার্যকর করেছেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং এখন ইউক্রেনকে সমর্থন করছেন।
জিএইচ/এসজি(রয়টার্স, এপি, এএফপি)