1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দল নিষিদ্ধ করা মানে রাজনৈতিক অক্সিজেন বন্ধ করা

১৬ মে ২০২৫

গণতন্ত্র হোক বা একনায়কতন্ত্র – যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক দল ছাড়া অচল৷ একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশে বিভিন্ন মতাদর্শের দলের সহাবস্থান জরুরি৷

সর্বশেষ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে ১০ই মে ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

তবে ইতিহাসের পাতায় এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যখন বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷

এই নিষেধাজ্ঞা জারির পেছনে যেমন নানা কারণ আছে, তেমনি নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ভিন্ন ভিন্ন৷ তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিষয়টিসারা বিশ্বজুড়েই একটি বিতর্কিত এবং জটিল প্রসঙ্গ৷ গণতন্ত্রের সুরক্ষার দোহাই দিয়ে কিছু চরমপন্থি বা অগণতান্ত্রিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিধান আছে৷ আবার অনেক দেশে একে রাজনৈতিক দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের উদাহরণও আছে৷ এর কার্যকারিতা এবং যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন সবসময়ই বিদ্যমান৷ বিশ্বে অনেক উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল বা দলের সদস্যরা আরো বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ফিরে এসেছে৷ আবার নিষিদ্ধের পর অনেক দলের প্রভাব কমে যাওয়ারও উদাহরণ আছে৷ তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা বা তাদেরকে রাজনীতি করতে না দেয়ার অর্থ হলো রাজনৈতিক অক্সিজেন সীমিত করা বা বন্ধ করে দেয়া৷ নির্বাহী আদেশে এমনটি করা মানে একেবারে গলা টিপে মারার উপক্রম হওয়া৷ বাংলায় একটি প্রবাদ আছে – ‘মূলে মাদুর নেই তার উত্তর শিয়র'৷ এর অর্থ হলো উত্তরে মাথা রেখে শোয়া নিষিদ্ধ৷ কিন্তু যার শোয়ারই জায়গাই নেই তার আবার উত্তর দক্ষিণ কী? রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ভাবা খুব জরুরি৷

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বহু রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, ইউরোপীয় কাউন্সিলের রাষ্ট্রগুলোতে দেড় শতাধিকরাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়৷ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলোতে প্রথম যে কারণটির কথা বলা হয়, সেটি হলো মতাদর্শিক বিরোধিতা৷ বহু দেশে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরোধিতা আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় শ্রমিক শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রোধে এসব দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ রাশিয়া, ফিলিপাইন, জার্মানি, আলজেরিয়াতে এমন নজির দেখা যায়৷ এখানে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, যে পার্টিগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ বেশ কমন ছিল৷ দলগুলোর মতাদর্শ গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থি এবং বিদেশি শত্রু দেশগুলোর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক৷ বিদেশি শক্তির সাথে সম্পর্কের অভিযোগে দল নিষিদ্ধের সবচেয়ে বেশি রেকর্ড সম্প্রতি ইউক্রেনের৷ দেশটিতে রুশপন্থি দলগুলোর প্রায় সবাই এখন নিষিদ্ধ৷ আবার ফ্যাসিবাদী ও নব্য-নাৎসি দলগুলোকেও বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ করতে আমরা দেখেছি৷ জার্মানি, রাশিয়া ও গ্রিসে এমন নজির আছে৷

গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি অজুহাতে অনেক দলকে নিষিদ্ধ করার উদাহরণ আছে৷ যেমন শ্রীলঙ্কায় তামিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট এবং রাশিয়ায় বাশকোর্ট ও অল-তাতার পাবলিক সেন্টারের কথা বলা যায়৷ পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে এই অভিযোগে ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ ২০২০ সালে পাকিস্তানের জয় সিন্ধ কওমি মাহাজ-আরিসার জঙ্গি সংগঠন দ্য সিন্ধুদেশ লিবারেশন আর্মি ও সিন্ধুদেশ রেভল্যুশন আর্মির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়৷

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকা বা মদদ দেয়ার অভিযোগটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে সহজ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকারের নির্বাহী আদেশে এমন আইনের অধীনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে৷ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে৷ এর আগে দেশটিতে জামায়াতে ইসলামীকেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ স্পেনের বাতাসুনা, আলজেরিয়াতে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট একই ধরনের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিল৷

বিদ্বেষ ও বৈষম্য ছড়ানোর অভিযোগে রাশিয়ার মেল স্টেট-এর মতো দল নিষিদ্ধ হয়েছে৷ তবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের জন্য প্রায়শই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের নজির আছে৷ যেমন আর্জেন্টিনা, সুদান, ও তুরস্কের কথা বলা যায়৷ আবার পাকিস্তানের তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানকে পুলিশ হত্যার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷

আরো একটি কারণে বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের নজির আছে৷ সেটি হলো গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ৷ জার্মানির সংবিধানে এমন দল নিষিদ্ধ করার বিধান রয়েছে৷ থাইল্যান্ডে পিপলস পাওয়ার পার্টি নির্বাচনি জালিয়াতির অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছিল৷ এক্ষেত্রে দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে একটি যুক্তি বিশ্বব্যাপী দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়৷ সেটি হলো মিলিট্যান্ট ডেমোক্রেসি৷ ধারণাটি হলো গণতন্ত্রকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে৷ যারা গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে তাকে ধ্বংস করতে চায় তাদের আটকাতে হবে৷ কিন্তু এখানে একটি প্যারাডক্স আছে৷ গণতন্ত্র বাঁচাতে গিয়ে অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নেয়া হচ্ছে কিনা – সে প্রশ্ন এখানে উঠে আসে৷ যেমন – দল নিষিদ্ধের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা সংগঠন করার অধিকার – এগুলো খর্ব করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এই টানাপোড়েনটাই হলো মূল বিতর্কের জায়গা৷ ওপরে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার যে কারণগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় নিরাপত্তার ধারণার সাথে গভীরভাবে জড়িত৷

গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সাথে এর আইনি ও নৈতিক ন্যায্যতার বিষয়টি সম্পর্কিত৷ বোহদান বার্নাটস্কি তার এক প্রবন্ধে তিনটি প্রধান পদ্ধতির রূপরেখা তুলে ধরেছেন, যা ইউরোপীয় দেশগুলো একটি দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমলে নেয়৷ এগুলো হলো লিবারেল মডেল, প্রাতিষ্ঠানিক মডেল এবং উগ্র গণতান্ত্রিক মডেল৷ লিবারেল মডেলে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধকে বিবেচনা করা হয়৷ প্রাতিষ্ঠানিক মডেলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করা, ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, রাজনৈতিক সহিংসতায় লিপ্ত হওয়া অথবা মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজের জন্য রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ ২০২২ সালে ইউক্রেন এই মডেলের অধীনে ১৭টি রাশিয়ানপন্থি দলকে নিষিদ্ধ করেছিল৷ সবশেষ উগ্র গণতান্ত্রিক মডেলে রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু তাদের আদর্শ বা লক্ষ্যের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ করা যায়৷ এমনকি তারা সহিংসতার আশ্রয় না নিলেও এখানে নিষিদ্ধ করা হয়৷

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ব্যাপারে যে বিতর্ক তার সাথে চলে আসে কার্যকারিতার প্রশ্ন৷ মানে, দল নিষিদ্ধ করে কি আসলেই আখেরে কিছু লাভ হয়? গবেষণা প্রতিবেদনগুলো বলছে, এর কোনো সহজ উত্তর নেই৷ সাফল্যটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে৷ যেমন – যে আদর্শটাকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে সমাজে তার শিকড় কতটা গভীর, নিষেধাজ্ঞা কতটা কড়াভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাই বা কেমন – এসব বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ফল সবসময় ইতিবাচক হয় না৷ অনেক উদাহরণ আছে যেখানে নিষিদ্ধ দল দিব্যি ঠিকে গেছে৷ অন্য নামে বা অন্য রূপে৷ যেমন – আয়ারল্যান্ডের সিন ফেইন বা মিশরের মুসলিম ব্রাদার হুড কিংবা ইরাকের বার্থ পার্টির কথা বলা যায়৷ এই দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ঠিকে ছিল, তাদের প্রভাব ছিল৷ এমনকি সিন ফেইন তো রেকর্ডও করেছে৷

আবার উল্টো দিকে সাফল্যের উদাহরণও আছে৷ অনেক দেশে নিষিদ্ধ করার পর দলগুলোর প্রভাব কমে গেছে এমন নজির আছে৷ তুরস্কে যেমন বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি বা স্পেনের ফেলেনজিস পার্টির কথা বলা যায়, যাদেরকে নিষিদ্ধের পর দলগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে বা প্রভাব কমে গেছে৷ তবে সেখানে রাষ্ট্রীয় দমন নীতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ অনেক কিছুই কাজ করেছে৷ এর অর্থ হলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিশ্বব্যাপী যে ইতিহাস সেটির ফলাফল বেশ মিশ্র৷

কার্যকারিতা এমন অনিশ্চিত হওয়ায় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বেশ কিছু ঝুঁকি থেকে যায়৷ গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে এদিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে৷ প্রথম যে ক্ষতির কথা বলা হয়, সেটি হলো – রাজনৈতিক ধারণাগত ক্ষতি বা পারসেপশন কস্ট৷ নিষিদ্ধ দলটি ভিকটিম কার্ড খেলে সহানুভূতি পেয়ে যেতে পারে৷ যেমন – বেলজিয়ামের ভ্ল্যান্স ব্লকের ক্ষেত্রে হয়েছিল৷ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা ভ্ল্যান্স বেলাং নামে ফিরে আসে৷ আরও শক্তিশালী হয়েছিল দলটি৷ মানে একেবারে উল্টো ফল হয়েছিল৷ আলবার্ট হার্শম্যান একে বলছেন ‘পারভার্সিটি' বা বিপরীত ফল৷ হার্শম্যানের থিসিস অনুযায়ী, রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার কোনো পদক্ষেপ প্রায়শই তার বিপরীত ফল বয়ে আনে৷ টিব বেল এই থিসিসকে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে, নিষেধাজ্ঞা বিপজ্জনক দলগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতন্ত্রের প্রতি তাদের হুমকির ধারণাকে বাড়াতে পারে৷ বেল হার্শম্যান এই ঝুঁকিটাকে বলছেন ‘জেপার্ডি' বা গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি৷ তিনি প্রশ্ন তোলেন যে, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্রের পূর্বে অর্জিত ইতিবাচক বিকাশ ও অর্জনগুলোকে বিপন্ন করবে কিনা৷ নিষেধাজ্ঞা একটি ইতিমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত গণতন্ত্রকে প্রতিশোধমূলক ও একপক্ষীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে পারে৷

বেলজিয়ামসহ আরো কয়েকটি দেশের উদাহরণ টেনে গবেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে৷ অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রাজনৈতিক দলের আদর্শের মোকাবিলা রাজপথে রাজনৈতিক বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমেই হওয়া উচিত, আইনি বা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে নয়৷ কারণ এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকারের সংকোচন ঘটায়৷ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা জনগণের ভোটাধিকার ও সংগঠনের স্বাধীনতার মতো মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী৷ এটি জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর বড় প্রভাব ফেলে৷ একটি দলের সমর্থকদের রাজনৈতিক অধিকার বস্তুত হারাতে হয়৷ শান্তিপূর্ণ জমায়েত বা বৈঠকও গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে পড়তে পারে৷ ফলে জনবিচ্ছিন্ন ও অর্থহীন নির্বাচন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়৷ এতে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এমন এক নির্বাচনের মুখোমুখি হয়, যেখানে তাদের সমর্থিত দল ব্যালটে অনুপস্থিত থাকে, যা নির্বাচনকে অর্থহীন করে তোলে৷ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধানগুলো বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ অনেক সময় ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল বা নির্মূল করার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়ার মতো কৌশল আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়৷

দ্বিতীয়ত, পালটা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি আছে৷ একে বলা হয় ব্যাকল্যাশ কস্ট৷ নিষিদ্ধ দল যেমন আরো জনপ্রিয়তা নিয়ে ফিরে আসতে পারে, তেমনি নিষিদ্ধ দলের সদস্যরা আরো উগ্র বা সহিংস হয়ে উঠতে পারে৷ জার্মানিতে এনপিডিকে নিষিদ্ধ করার আগের চেষ্টাগুলোর সাথে তাদের সদস্যদের সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার একটা সম্পর্ক গবেষণায় খুঁজে পাওয়া গেছে৷

আরো একটি ঝুঁকি আছে৷ সেটি হলো আইনি কাঠামোগত ক্ষতি৷ যাকে ইংরেজিতে বলা হয় লিগ্যাল-স্ট্রাকচারাল কস্ট৷ এর মানে হলো একটা দলকে নিষিদ্ধ করতে গিয়ে সরকার বা আদালত এমন কোনো রায় বা মাপকাঠি তৈরি করে ফেলতে পারে যেটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিপদে ফেলতে পারে৷ আবার এই মাপকাঠি এমনও হতে পারে যেটির জন্য ভবিষ্যতে কোনো দলকে দরকার হলেও নিষিদ্ধ করা কঠিন হয়ে যেতে পারে৷ যেমন – জার্মানির এনপিডির ক্ষেত্রে আদালত যে মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে তা ভবিষ্যতের জন্য চিন্তার জন্ম দেয়৷

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধেরক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়টি হলো র বিস্তার৷ কোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে সেই দলের সদস্যরা সহিংস বা উগ্র পথে ধাবিত হতে পারে৷ এটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তরকে অকার্যকর করে তোলে এবং প্রায়ই নতুন অস্থিতিশীলতার চক্রকে উসকে দেয়৷ আবার রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা সমাজে অবিশ্বাস ও বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে৷ এটি একটি বিভক্ত সমাজকে আরও গভীরভাবে মেরুকৃত করে তুলতে পারে৷ ২০১৭ সালে জার্মানির সাংবিধানিক আদালত নব্য নাৎসির ভাবধারার এনপিডি দলকে নিষিদ্ধ করতে রাজি হয়নি৷ জার্মান আদালত তখন বেশ কড়া একটি মাপকাঠি সামনে এনেছিল৷ জার্মান আদালত এই মাপকাঠিকে বলেছিল পোটেনসিয়ালিটি বা সম্ভাব্যতা৷ এর মানে হলো শুধু দলের লক্ষ্য অগণতান্ত্রিক হলেই চলবে না, প্রমাণ করতে হবে দলটির সেই লক্ষ্য পূরণ করার মতো ক্ষমতা বা সম্ভাবনা আছে৷ অর্থাৎ খারাপ উদ্দেশ্য হাসিল করার মতো সামর্থ্য থাকতে হবে৷ তবে অনেকেই মনে করেন, এদের মাপকাঠি নির্ধারণ করতে গেলে একটি ঝুঁকি থেকে যায়৷ এজন্য এই সম্ভাব্যতার মাপকাঠিটা বেশ বিতর্কিত৷ ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের যে মাপকাঠি সেটিকে বলা হয় আসন্ন হুমকি বা এমিনেন্ট থ্রেট, সেটি অবশ্য আর একটু নমনীয়৷ ইসিএইচআর সাধারণত দেখে সমস্যা বা ঝুঁকি দরজার কাছে এসে গেছে কীনা৷ যেমন তুরস্কের ওয়েলফেয়ার বা রেফাহ পার্টি৷ ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি তুরস্কের একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল ছিল৷ দলটি তৈরি হয়েছিল আগের দুটি দল এমএনপি এবং এসএসপি রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ায়৷ পরবর্তীতে দেখা গেল রেফাহ পার্টি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে৷ তখন ১৯৯৮ সালে তুরষ্কের সাংবিধানিক আদালত ওয়েলফেয়ার পার্টিকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে৷ কিন্তু তাতে কী লাভ কিছু হয়েছে? তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপতি এরদোগান রেফাহ পার্টিরই একজন প্রাক্তন সদস্য৷ কিছুদিন রাজনীতিতে তিনি নিষিদ্ধ ছিলেন৷ এরপর গঠন করেন নতুন পার্টি – একেপি৷  

বিশ্বে অনেক উদাহরণ আছে, যারা বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল, পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার ফিরে পেয়েছে৷ এমন দলগুলো প্রায়শই একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়৷ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর কথা বলা যায়৷ মিশর, নেপাল, গ্রিস, ব্রাজিল, জার্মানির ও ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টি, আফ্রিকার এএনসি, পাকিস্তানের তেহরিক-ই-লাব্বাইক পার্টিগুলোর নিষেধাজ্ঞা পরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল৷ এই উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন, সরকারের নীতি পরিবর্তন অথবা দলের কৌশলগত অভিযোজনের ফলে নিষিদ্ধ দলগুলো পুনরায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়৷

আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে অন্য কথাও ভাবতে হয়৷ সেখানে অনেকে বলছে, দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল বাড়ছে; একে অপরের বৈধতা মানছে না৷ আমেরিকায় কেউ কেউ দলহীন বা কম দলীয় প্রভাবের গণতন্ত্রের কথা ভাবছেন৷ যেমন – লটারির মাধ্যমে নাগরিক পরিষদ বা সিটিজেন এসেম্বলি তৈরি করা৷

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার কার্যকারিতা অত্যন্ত বিতর্কিত৷ এটি কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সুরক্ষায় সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে যখন দলগুলো সহিংসতা বা সরাসরি গণতন্ত্রকে উৎখাত করার চেষ্টা করে৷ তবে অনেক ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা আকাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনে না৷ এটি গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে, বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, উগ্রবাদকে উৎসাহিত করতে পারে, সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ দলটিকে আরও শক্তিশালী বা জনপ্রিয় করে তুলতে পারে৷ একটি শক্তিশালী জনভিত্তিসম্পন্ন দলকে কেবল নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করা প্রায়শই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়৷ ইতিহাস দেখিয়েছে, অনেক নিষিদ্ধ দল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে এসেছে এবং এমনকি সরকারও গঠন করেছে৷ এমন নানান জটিলতা, মিশ্র ফলাফল, এমনকি একেবারে বিপরীতধর্মী ফলাফল থাকার রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও এখনও কেন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়? তার মানে যারা দল নিষিদ্ধ করে তাদের কাছে এটি অনিবার্য কিন্তু বিপজ্জনক শেষ চেষ্টা, যা প্রায়শই ব্যর্থ হয়৷ বাংলাদেশের মত রাষ্ট্র, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বক্তাদের মুখে মুখে আর কেতাবে থাকে, সেসব দেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ফলাফল ধারণার চেয়ে অনেক বেশি নেতিবাচক হবে৷ সংস্কৃতে একটা কথা আছে, ‘আতুরে নিয়মো নাস্তি'৷ অর্থ হলো রোগীর পক্ষে উপবাস নিয়ম নিষিদ্ধ বা অসমর্থের জন্য নিয়ম খাটে না৷ বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে জরুরি, সেখানে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ ভবিষ্যতে বিশৃংখলা আরো বাড়াতে পারে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ