তলব হয়েছিল আগেই, এবার দশ দেশের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের কথা জানালেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।
বিজ্ঞাপন
কূটনীতির ভাষায় 'পার্সোনা নন গ্রাটা' একটি ভারী শব্দ। এর অর্থ, অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। দশ পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে এই মর্মেই নোটিস জারি করার নির্দেশ দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান। পার্সোনা নন গ্রাটা ঘোষণার পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, ওই ব্যক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা। দশ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও সে কাজ করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। জার্মানি, অ্যামেরিকা-সহ একাধিক উন্নত দেশের রাষ্ট্রদূতেরা ওই তালিকায় আছেন। কারণ, তারা অ্যাক্টিভিস্ট ওসমান কাভালার মুক্তির দাবিতে একটি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন।
ভোটের স্বার্থে ধর্ম ব্যবহারের অভিযোগ, এর্দোয়ানের জবাব
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এমন দেশগুলোতে সরকারি অনুষ্ঠানে অন্তত বিশেষ কোনো ধর্ম অগ্রাধিকার পায় না৷ অথচ সেকুলারদের অভিযোগ- ভোট বাড়াতে এর্দোয়ান ইসলামকে ব্যবহার করছেন৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Präsidialamt für Kommunikation/Iletisim Baskanligi
এর্দোয়ানের একে পার্টি এবং ইসলাম ধর্ম
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের রাজনৈতিক দলের নাম জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) হলেও দলটির বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগটা পুরোনো৷
ছবি: Adem Altan/AFP/Getty Images
গির্জা থেকে আবার মসজিদ
এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতি উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ বড় হয়ে ওঠে ২০০০ সালে৷ এক সময়ের গির্জা আয়া সোফিয়াকে ১৪৫৩ সালে দখল করে অটোমান সাম্রাজ্য৷ পরবর্তীতে তা মসজিদ এবং তারপর জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়৷ তুরস্কে মুসলমান-খ্রিষ্টান ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা স্থাপনাটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাও পেয়েছিল৷ কিন্তু আদালতের রায়ে তা আবার মসজিদ হলে জুম্মার নামাজ পড়ে তার উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের বাইরেও এর্দোয়ানের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে মূলত ধর্মীয় নেতা আলী এরবাসকে৷ আয়া সোফিয়ায় ৯০ বছর পর যেদিন প্রথম নামাজ হলো, সেদিন খুতবা পড়িয়েছিলেন তিনি৷ সেই থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সরকারি ভবন উদ্বোধন করা হলেই দেখা যায় তাকে৷
ছবি: Murad Sezer/REUTERS
আদালতের উদ্বোধনে আলী এরবাস
চলতি মাসে আঙ্কারায় একটি নতুন আদালত ভবনের উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷ আলী এরবাসকে দিয়ে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক বিশেষ দোয়া পাঠ করানোর কারণে আবার শুরু হয় সমালোচনা৷ তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদরা বলছেন, এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের চরম অমর্যাদা হয়েছে৷ তারা মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশি হলেও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় শুধু সেই ধর্মের অস্তিত্ব তুলে ধরা উচিত নয়৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Presidential Press Office/REUTERS
যুক্তরাষ্ট্রেও আলী এরবাস
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে সুউচ্চ এক ভবনের উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷ নিউইয়র্কে বসবাসরত তুর্কি কূটনীতিকদের জন্য নির্মাণ করা ভবনটির উদ্বোধনেও নতুন কিছু দেখা যায়নি৷ সেখানেও হাজির ছিলেন আলী এরবাস৷ সেখানেও তার নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মমতে দোয়া-দরুদ পড়েই শুভ উদ্বোধন হয় ভবনটির৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Presidential Press Office/REUTERS
ভোটের আগে ধর্মের রাজনীতি?
বিরোধীদের অভিযোগ- ২০২৩ সালের নির্বাচনে ভোট বাড়াতেই ইসলাম ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন এর্দোয়ান৷ সম্প্রতি ধর্ম বিষয়ক জাতীয় পরিষদ দিয়ানেটকে ঘিরেও এমন অভিযোগ উঠেছে৷ দিয়ানেটের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেলে ৩০ জন কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, দিয়ানেটের বাজেট তুরস্কের অনেক মন্ত্রণালয়ের চেয়েও বেশি৷ তারপরও আগামী বছর প্রতিষ্ঠানটির বাজেট বাড়িয়ে ১.৮৬ বিলিয়ন করার ঘোষণা দিয়েছেন এর্দোয়ান৷
ছবি: Präsidialamt für Kommunikation/Iletisim Baskanligi
বাড়ছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ
তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদরা সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, এর্দোয়ান বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের ভোট টানতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইমাম হাতিপ’ স্কুল ও মসজিদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছেন৷ গত এক দশকে তুরস্কে মসজিদের সংখ্যা শতকরা দশভাগ বেড়েছে৷
ছবি: Muhammed Enes Yildirim/AA/Getty Images
১০০ বছর আগের ছবিতে এর্দোয়ানের জবাব
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহারের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেননি রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান৷ বরং তার কার্যালয় থেকে ১০০ বছর আগের একটি ছবি শেয়ার করা হয়েছে৷ সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নতুন পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নামাজ পড়ছেন ‘আধুনিক তুরস্কের জনক’ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক৷ ওপরের ছবিতে এর্দোয়ান ও তার স্ত্রী এমিনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Unal
8 ছবি1 | 8
জার্মানি, অ্যামেরিকা, ক্যানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ওই দলে আছেন। গত মঙ্গলবার ওই রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছিল তুরস্কের সরকার। তাদের সঙ্গে কথা বলার পরেই শনিবার নিজের বক্তব্য জানান এর্দোয়ান। সকলের বিরুদ্ধে পার্সোনা নন গ্রাটার নোটিস জারি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, 'যারা তুরস্ককে চেনে না, তাদের তুরস্কে থাকারও কোনো অধিকার নেই।'
তুরস্কের এই হুমকির পরে মুখ খুলেছে একাধিক দেশ। জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদসংস্থা ডিপিএ-কে জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বাকি নয়টি দেশের সঙ্গে তারা আলোচনা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ বিষয়ে টুইট করেছে।
নরওয়ে এবং ডেনমার্কও জানিয়েছে তারা এখনো কোনো নোটিস সরকারিভাবে পায়নি। তবে অন্য দেশগুলির সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছে। নরওয়ে জানিয়েছে, তাদের রাষ্ট্রদূত এমন কোনো কাজ করেননি, যার জন্য এমন সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এই ঘটনার ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরো জটিল হবে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল। যেভাবে এর্দোয়ান চরম পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্ব তা ভালো চোখে দেখছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ডেনমার্ক জানিয়েছে, মানবাধিকার নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিল। ভবিষ্যতেও তোলা হবে। তুরস্ককে তা মানতেও হবে, কারণ ইউরোপিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের অংশ তুরস্ক।
দশটি দেশ অ্যাক্টিভিস্ট ওসমান কাভালার মুক্তির দাবিতে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। ২০১৭ সালে ওসমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ। তিনি এর্দোয়ান বিরোধীদের গেজিপার্ক প্রোটেস্টে মদত দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ২০১৬ সালের সরকারবিরোধী বিদ্রোহেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। যদিও তা সফল হয়নি।
এর আগে তার বিরুদ্ধে ওঠা দুইটি অভিযোগই আদালতে প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে জেল থেকে ছাড়া হয়নি। নতুন করে মামলাগুলি সাজানো হয়েছে।