সরকার ভোজ্য তেল আর চিনির দাম বাড়ানোর পর এখন সব কিছুর দাম ফের বাড়ছে৷ সেইসঙ্গে বাড়ছে মানুষের কষ্ট৷ এর সঙ্গে কোনোভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না সাধারণ মানুষ৷
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশনের(টিসিবি) হিসাবই বলছে চিনি, তেল, চাল, ডাল, আটা, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম আরো এক দফা বেড়েছে৷
এক সপ্তাহে মোটা চাল কেজিতে বেড়েছে দুই টাকা, আটার দাম বেড়েছে তিন টাকা, মসুর ডাল বেড়েছে পাঁচ টাকা আর সয়াবিন তেল বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা, চিনি বেড়েছে ১৩টাকা৷ সরকার ঘোষণা দিয়ে তেল ও চিনির দাম বাড়ানোর পর বাজারে এই দুইটি পণ্যের সংকট তৈরি হয়েছে৷
টিসিবির হিসাবে, ২০২১ সালে সয়াবিন তেলের লিটার ছিল ১৫৩ টাকা আর এখন লিটার ১৯০ টাকা আর ২০২০ সালে ছিল ১১৪ টাকা৷ চিনি গত বছর কেজি ছিল ৭৮ আর এখন ১০৮ টাকা৷ ২০২০ সালে ছিল ৬৮ টাকা৷
''প্যাকেটজাত চিনির, সয়াবিন তেলের দাম বাড়বে''
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ(সিপিডি) গত অক্টোবরে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাজারে অনেক পণ্যের দাম শতকরা ২০ থেকে ৫০ ভাগ বেড়েছে৷ ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারের অক্টোবর মাসের খাবারের হিসাব তুলে ধরে সিপিডি জানায়, মাছ ও কোনো প্রকার মাংস না খেলে ওই পরিবারকে মাসে খাবার কিনতে খরচ করতে হয় গড়ে নয় হাজার ৫৯ টাকা৷ এর সঙ্গে মাছ ও মাংস যুক্ত হলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৪২১ টাকা৷গত এক মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে৷
টিসিবির দামে বাস্তবে কোনো পণ্য নেই
টিসিবির যে পণ্য তালিকা ও দাম আছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাদের তালিকাভুক্ত ১০৭টি ভোগ্য পণ্যের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের দামই নতুন করে বেড়েছে৷ আর এই বৃদ্ধির হার পাঁচ থেকে ২০ ভাগ৷
অন্যদিকে বাস্তবে টিসিবি যে দাম লিখে রাখে সেই দামে কোথাও পণ্য পাওয়া যায় না৷ দাম তার চেয়ে বেশি৷ যেমন টিসিবি বলছে গরুর মাংসের কেজি ৬৬০ টাকা কিন্তু ৭০০ টাকার নিচে ঢাকায় কোথাও গরুর মাংস নেই৷ টিসিবির দামের সঙ্গে বাজারে কোথাও মিল পাওয়া যাচ্ছেনা৷
কলবাগানের দোকানদার মিন্টু মিয়া জানান, বাজারে এখন সরু চালের কেজি ৮৫ টাকা, প্যাকেট আটা কেজি ৭৫ টাকা, মসুর ডাল কেজি ১৬০ টাকা, পেঁয়াজ ৬০ টাকা, রসুন ১৬০ টাকা কেজি৷ কিন্তু টিসিবি বলছে সরু চাল কেজি ৭২ টাকা, আটা ৬৫ টাকা, মসুর ডাল ১৪৫ টাকা , পেঁয়াজ ৪৫ এবং রসুন ১৩০ টাকা৷ প্রতিটি পণ্যের দাম সিবির লেখা দামের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেশি৷
মিন্টু মিয়া জানান," এখন প্যাকেটজাত চিনি বাজারে নেই৷ আর সয়াবিন তেলও চাহিদা মত পাওয়া যায়না৷ এই দুইটি পণ্যের দাম নাকি আরো বাড়বে৷”
পরিস্থিতি সামলাতে সাধারণ মানুষ এখন ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমিয়েছে।তারা মাছ, মাংস খাওয়া বাদ দিচ্ছে৷ নাজমুল হক তপন নামের একজন বেসরকারি কর্মী বলেন," আমাদের পরিবারে গত তিন মাস ধরে গরুর মাংস খাওয়া হয় না৷ মুরগির মাংসও বলতে গেলে খাইনা৷ যা আয় তা দিয়ে গরুর মাংস কেনা সম্ভব নয়৷ মাছ খাই৷ তবে যেসব মাছের দাম কম যেমন তেলাপিয়া এগুলোই খাচ্ছি৷ বাজারে এখন সবজির দাম কমতে শুরু করেছে৷ যে সব সবজির দাম কম সেগুলো কিনি৷ ফুলকপির দাম বেশি তাই কিনি না৷ আমার বাচ্চাদের কারণে সরু চাল এখনো কিনছি৷ কিন্তু আর মনে হয় পারব না৷ শেষ পর্যন্ত মোটা চালই খেতে হবে৷”
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের(ক্যাব সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন," সরকার যে ভোজ্য তেল এবং চিনির দাম বাড়াল তার প্রতিক্রিয়া পড়েছে বাজারে৷ ওই পণ্যের দাম বাড়ায় অন্য পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে৷ ব্যবসায়ীরা মনে করে তারা বাড়ালে আমরা কেন বাড়াব না৷ এই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে৷ ফলে প্রত্যেক জিনিসের দামই নিয়মিতভাবে বাড়ছে৷”
তার কথায়," সাধারণ মানুষ এখন অসহায়৷ তারা কম কিনে, কম খেয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে৷ যারা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করেন তাদের বিক্রি কমে গিয়েছে৷”
দেলোয়ারা বেগম, মুজিবুল হক, ঝর্ণা রানী দাশরা কারওয়ান বাজারে যান কিছুটা কম দামে নিত্যপণ্য কেনার আশায়৷ দু-একটি পণ্য ছাড়া বাকিগুলোর দাম এমন যে দেলোয়ারা বেগম জানতে চাইলেন, ‘‘গরিব মানুষ বাঁচবে কী করে?’’ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সয়াবিন তেলের দাম চড়া
সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে চার দিন আগে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৯২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১৮৫ টাকা। পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম সরকারিভাবেই নির্ধারণ করা আছে ৯৪৫ টাকা। কিন্তু কারওয়ান বাজারে পাইকারি মার্কেটে ৯২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন ব্যবসায়ী সুমন তালুকদার।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
চালও নাগালের বাইরে
সবচেয়ে মোটা চালের নাম স্বর্ণা। তা-ও কেজি ৫২ টাকা। মিনিকেট ৭৫ টাকা আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে। বিক্রেতারা জানালেন, দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি চালের দাম ৫ থেকে ৮ টাকা কম ছিল। গত দুই মাসে পর্যায়ক্রমে বেড়েছে চালের দাম। পরিস্থিতি এমন যে গরিবের পক্ষে মোটা চাল কিনে খাওয়াও দায়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ডালের দামও বেশি
প্রতি কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে ডালের দাম। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর পর্যায়ক্রমে এই দাম বেড়েছে। মসুর ডালের কেজি আগে ছিল ১১৫ টাকা, এখন ১৩০ টাকা। মোটা মসুরের ডালও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মুগ ডাল ৮৫ টাকা থেকে হয়েছে ৯৫ টাকা। ছোলার ডাল ৬৫ টাকা থেকে হয়েছে ৭৫ টাকা।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লাফিয়ে বাড়ছে মুরগির দাম
ব্রয়লার মুরগি এখন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। পাকিস্তানি কর্ক বিক্রি হচ্ছে ২৯০ টাকা কেজি দরে। আগে এই ধরনের মুরগির কেজি ছিল আড়াইশ’ থেকে ২৬০ টাকা। আর দেশি মুরগির দাম নাগালের বাইরে। সাড়ে ৪শ’ টাকা কেজি দরে এখনও বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ৪০০ টাকার মতো।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
চাষের মাছও কেনা দায়
নদীর কোনো মাছ এখন আর ৫০০ টাকা কেজির কমে পাওয়া যায় না। আগে একটু কম দাম ছিল চাষের মাছের। যেমন, চাষের কই বিক্রি হতো ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি, এখন বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ’ টাকায়। চাষের পাঙ্গাস মাছও এখন ৪০০ টাকা কেজি। চাষের রুই মাছের কেজি সাড়ে ৩শ’ টাকা। এছাড়া নদীর মাছের মধ্যে পাবদা, চিংড়ি, ট্যাংড়া, পুঁটি, বাইম, আইড়- এর দাম ৫৫০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সবজির দামে সামান্য স্বস্তি
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল সবজির দাম। তবে পর্যায়ক্রমে তা একটু কমেছে। আলুর কেজিপ্রতি দাম উঠেছিল ৪০ টাকায়, এখন তা নেমে এসেছে ২৫-৩০ টাকায়। বেগুন প্রকার ভেদে ৪০ টাকা থেকে ৭০ টাকা। ঢেড়স ৪০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসবের দাম কয়েকদিন আগে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি ছিল।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
স্থিতিশীল পেঁয়াজ
বর্তমানে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। তবে কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানগুলোতে প্রতি কেজি ৫০ টাকা। সেখানে অবশ্য ৫ কেজির কম কেনা যায় না। দুই সপ্তাহ আগেও খুচরা বাজারে ৭০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে পেঁয়াজের বাজার।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
উত্থানের পর ডিমের দামে স্বস্তির পতন
ডিমের দাম হু হু করে বাড়ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ডজন বিক্রি হতো ব্রয়লার মুরগির ডিম। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সেটা ১৫০ টাকায় উঠেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বানিজ্যমন্ত্রী ডিম আমদানির ঘোষণা দেওয়ার পর দাম কমতে শুরু করে। এখন আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মুরগির খামারিরা সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়েছিলেন।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
কাঁচা মরিচে স্বস্তি
কাঁচা মরিচের বাজারে বেশ স্বস্তি ফিরেছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর কাঁচা মরিচের কেজি এক পর্যায়ে ৩০০ টাকায় উঠেছিল। তবে খুচরা বাজারেই এখন কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। কারওয়ান বাজারে দাম আরো কম। শনিবার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেল কেউ কেউ ৩০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি করছেন কাঁচা মরিচ। বিক্রেতারা বলছেন, এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় কাঁচা মরিচের গাছগুলো পচেনি, বরং ফলন ফালো হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
কারওয়ান বাজারে দাম একটু কম
শনিবার কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে দেখা গেল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা ঝর্ণা রানী দাসকে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, তেঁজকুনি পাড়া থেকে বাজার করতে এসে তিনি দেখেছেন কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি সবজি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে পাওয়া যায়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
‘হিসাব মিলছে না’
বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে অবসর নেয়া মুজিবুল হকের এখন চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তারপরও কলাবাগান থেকে কারওয়ান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে তার হিসেব মিলছে না। একটু কমের আশায় কারওয়ান বাজার এসেছেন। একবারে পুরো সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে যাবেন তিনি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
‘বেতন তো বাড়ছে না!’
সরকারি চাকরি করেন আহসান কবীর। নিজের পরিচয় খানিকটা লুকিয়ে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে। কিন্তু বেতন তো বাড়েনি। মানুষ চলবে কিভাবে? তাই ছুটির দিনগুলোতে যে জিনিস যেখানে কমে পাওয়া যায় সেখান থেকে কিনি। সে কারণে এসেছি কারওয়ান বাজারে। পুরো সপ্তাহের বাজার এখান থেকে করলে অন্তত ৪-৫শ’ টাকা সেভ হবে।’’
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
গরিব মানুষের বেঁচে থাকা দায়
গৃহবধূ দেলোয়ারা বেগমের পাঁচ জনের সংসার। তারা স্বামী-স্ত্রী আর দুই সন্তান ও শ্বাশুড়ি। পাড়ার মোড়ে তার স্বামী চায়ের দোকান চালান। দোকান থেকে প্রতিদিন ৩-৪শ’ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া, থাকা-খাওয়া সব চালানো কঠিন৷ বললেন, ‘‘করোনার পর তো ছেলে-মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। সংসারই চলে না, ওদের পড়াবো কীভাবে? এখন যে অবস্থা তাতে আমাদের মতো গরিব মানুষের বেঁচে থাকাই দায়৷’’