ভালোবাসার বিয়ে নয়, সম্বন্ধ করে বিয়ে – ‘আধুনিক' ভারতবর্ষে আজও যেভাবে অধিকাংশ বিয়ে হয় আর কি! বিয়ের পর বাসর ঘরে লজ্জায় রাঙা হয়ে অপেক্ষা করছে কনেবউ৷ স্বপ্ন দেখছে কীভাবে শুরু হবে দু'জনের বন্ধুত্ব, নতুন পথচলা৷ কিন্তু...
বিজ্ঞাপন
স্বামী ঘরে ঢোকার পর মুহূর্তেই পালটে যায় তার জীবন৷ ভেঙে, গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা৷ অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কী এমন ঘটলো বাসর ঘরে? না, তেমন কিছু নয়৷ খুব সাধারণ ব্যাপার৷ স্বামী এসে দু-একটা মিষ্টি কথা বলা তো দূরের কথা, একরকম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেয়েটির শরীরে৷ যন্ত্রণায় চিৎকারও করতে পারেনি সে, মুখে গুঁজে দেয়া হয়েছিল চাদর...৷ বাহ্ রে, নিজের বউ বলে কথা৷ তার ওপর জোর-জবরদস্তি করার একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে না স্বামীর? আর ‘বিয়ে' তো শুধু নারী-পুরুষের মধ্যকার সামাজিক ও ধর্মীয় চুক্তি নয়, এ তো স্বামীর ইচ্ছে মতো স্ত্রীকে ভোগ করার একটি বৈধ ‘লাইসেন্স'৷ তাই না?
আপনার উত্তর যাই হোক, ভারত তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে এটাই সত্য৷ আসলে স্বামী যদি স্ত্রীকে শারীরিক নিযার্তন করে আর ভুক্তভোগী স্ত্রী আইনের আশ্রয় নেয় – তাহলে ধীরে হলেও ব্যাপারটা আমরা মেনে নিতে শুরু করেছি৷ কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে – এটা মেনে নিতে আজও কোথাও যেন বাধে৷ ‘ম্যারিটাল রেপ' বা দাম্পত্য ধর্ষণ এখনও যে অপরিচিত না হলেও অনুচ্চারিত একটি শব্দ! এর পেছনে অবশ্য রয়েছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক অবকাঠামো, যেখানে স্ত্রীকে আজও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা হয় স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে৷ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা রয়েছে , তাতে স্বামীকে ধর্ষকের ভূমিকা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সযত্নে (স্ত্রীর বয়স যদি ১৫ বছরের নীচে না হয়)৷ অর্থাৎ স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রাখা কোনো অপরাধ নয়৷ তাই স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও, তাকে ‘ধর্ষণ' বলা যাবে না৷ ভারতের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন (আইসিআরডাব্লিউ) বা আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, স্ত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে প্রতি পাঁচজনের একজন ভারতীয় পুরুষ৷ তাও আবার লজ্জিত হয়ে নয়, বেশ গর্ব করেই৷
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ৫২টি দেশ ‘ম্যারিটাল রেপ'-কে আইনের অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং শাস্তির বিধান রেখেছে৷ ইংল্যান্ডে অবশ্য ১৯৯২ সালেই স্ত্রীকে ধর্ষণের অপরাধ থেকে স্বামীকে অব্যাহতি দেয়ার আইনটিকে অবলুপ্ত করে ‘হাউস অফ লর্ডস'৷ এরপর ১৯৯৩ সালের জুলাই মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব রাজ্যে দাম্পত্য ধর্ষণকে বে-আইনি ঘোষণা করে৷ দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে মেনে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মেক্সিকোও৷ ওদিকে আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া ও নেপালে দাম্পত্য ধর্ষণ বিরোধী আইন থাকলেও, ধর্ষক স্বামীর জন্য অতি সামান্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে৷ অথচ ভারত-বাংলাদেশে...?
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
11 ছবি1 | 11
এখানে নারীকে পারিবারিক চাপ অথবা অন্য উপায় না থাকার ফলে বছরের পর বছর বাস করতে হয় ‘স্বামী' নামের ধর্ষকের সঙ্গে৷ একবার নয়, হয়ত প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে ধর্ষণ হয় তার৷ লোকলজ্জার ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না সে৷ তাই বয়ে বেড়াতে হয় যৌন রোগ, ক্ষত বা মানসিক অসুখ৷ তাই কোনো নারীকে যদি প্রশ্ন করেন – আপনার স্বামী কি আপনাকে ধর্ষণ করছেন? – তাহলে বেশিরভাগ নারীই এক হয় চুপ হয়ে যাবে কিংবা পড়ে যাবে চিন্তায়৷ আর কেউ যদি সাহস করে সত্যটা বলেও ফেলে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী? কে দেবে তাকে পুনর্বাসন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ? পরিবার? রাষ্ট্র? ধর্ম?
কেউ না৷ আর সে জন্যই ধর্ষক স্বামীরা আজও বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর মেয়েরা পুতুল খেলতে খেলতে মুখ বন্ধ করে ‘ধর্ষিতা' হন!