সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচেছ৷ কাজের অনুমতি (আকামা) আছে এমন শ্রমিকদেরও ফেরত পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে৷ তবে তাদের অধিকাংশই অবৈধ বলে দাবি করেছেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত৷
বিজ্ঞাপন
শুক্র ও শনিবার ২৪ ঘন্টায় সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছেন ৩৭৩ জন শ্রমিক৷ সৌদি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর দূতাবাসের মাধ্যমে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তাদের কেউ কেউ দেশে ফেরত আসার আগে কারাগারেও ছিলেন৷ তেমনই একজন ভোলার লালমোহন উপজেলার ফুয়াদ হোসেন৷ তিনি ২০১৭ সালে ১২ মাসের আকামায় সৌদি আরব গিয়েছিলেন৷ কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ পাননি৷
রিয়াদে একটি পেট্রোল পাম্পে তিন মাস চাকুরি করার পর আরো নানা জায়গায় কাজ করেন ফুয়াদ৷ আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থেকে যান৷ নতুন করে আকামা বা কাজের অনুমতি নিতে অনেক টাকা লাগে বলে তাও নেননি৷ আট দিন আগে তিনি দেশে ফেরেন৷ তার আগে সৌদি পুলিশের হাতে আটক হয়ে সেখানকার কারাগারে ছিলেন৷ তিনি জানান, ‘‘এখন সৌদি পুলিশ ধরে ধরে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে৷ যাদের আকামা আছে তাদেরও৷ পুলিশ কোনো কথাই শুনতে চায় না৷'' তিনি ছয় লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছিলেন৷ দেশে পাঠাতে পেরেছেন মাত্র দুই লাখ টাকা৷
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে জানান, চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার প্রবাসী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন৷ তাদের মধ্যে ২৫ হাজারই এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে৷ সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১৮ হাজারের মত৷ প্রতিমাসেই গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক দেশটি থেকে ফিরে আসছে৷
শরিফুল হাসান
তিনি জানান, ‘‘সৌদি আরবে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি থাকার পরও ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে তারা আমাদের জানাচ্ছেন৷ পুলিশ তাদের আটক করে কারাগারে পাঠাচ্ছে৷ আমরা যেটা জানতে পেরেছি তাদের বড় একটি অংশ গেছেন ফ্রি ভিসায়৷ বলা হচ্ছে তারা যেকোনো জায়গায় কাজ করতে পারবেন৷ কিন্তু সৌদি আইনে যে প্রতিষ্ঠানে কাজের অনুমতি আছে তার বাইরে কাজের কোনো সুযোগ নেই৷ আরেকটি কারণ হলো যারা অনেক টাকা খরচ করে যান তারা নির্ধারিত সময়ে তাদের টাকা তুলতে পারেন না৷ তাই তারা আরো অনেক জায়গায় কাজ করেন, কোম্পানি পরিবর্তন করেন৷ মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থেকে যান৷''
ফুয়াদ হোসেন অভিযোগ করেন, ‘‘বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবে আকামা বিক্রির চক্র আছে৷ তারা নানাভাবে বুঝিয়ে দুই-তিন লাখ টাকায় আকামা বিক্রি করে৷ আরো অনেক খরচ আছে৷ আকামার মেয়াদও কম থাকে৷ নেয়া হয় ফ্রি ভিসায়৷ বলা হয় কাজে কোনো সমস্যা হবে না৷ তাদের কারণেই সৌদি আরবে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা৷''
গোলাম মসিহ
সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ এই পরিস্থিতির জন্য জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরই দায়ী করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সৌদি আরব যাদের ফেরত পাঠাচ্ছে আমরা তা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি৷ শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন৷ কারণ যারা আটক হচ্ছেন তারা আকামার শর্ত লঙ্ঘন করছেন৷ কারণ সৌদি আইনে যেখানে কাজের অনুমতি সেখানেই কাজ করতে হবে, সেখানেই থাকতে হবে৷ কিন্তু যারা লোক পাঠায় তারা শ্রমিকদের ভুল বুঝায়৷ নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজের পরে অন্য কোম্পানিতে কাজের জন্য উৎসাহিত করে৷ আকামা বিক্রির সময়ও তারা এখানে অনেক বেশি রোজগারের লোভ দেখায়৷ আর তার পরিণতি ভোগ করতে হয় নিরীহ শ্রমিকদের৷ তারা নিজেরাও আইন ঠিকমত জানে না৷ ডিপোর্টেশন সেন্টার থেকে আউটপাস দেয়ার আগে আমরা শ্রমিকদের সাথে কথা বলছি৷ তারা প্রত্যেকেই এখানে বেআইনিভাবে কাজ করছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই কারণে আমাদের দেশ সম্পর্কে এখানে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচেছ৷ তারা মনে করে আমাদের দেশের লোকজন এখানে অবৈধভাবে কাজ করে৷ তবে এ কারণে সৌদি শ্রমবাজারে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে হয় না৷''
তিনি এজন্য ঢাকার শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্টদের কঠোর ব্যবস্থার আওতায় আনার কথা বলেন৷
যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি
প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা কাজ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে৷ বৈধপথে বিদেশে যাওয়া এসব প্রবাসীর হিসাব রাখে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি৷
ছবি: DW
এক কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশের ঠিক কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিএমইটি-র হিসাবে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তবে কতজন ফিরে এসেছেন সেই পরিসংখ্যান নেই সেখানে৷
ছবি: Positive light
১৪ লাখ কোটি টাকা
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের আয়৷ এর কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও এখন বেশ শক্তিশালী৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩৬ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে৷ সেই তুলনায় রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে৷ শুধু গত বছরই এসেছে ১৮৩৫ কোটি ডলার বা এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার বা ১৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
ছবি: AFP
এক তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্য সৌদি আরব, যেখানে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৪১ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন দিয়ে এই শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫১ হাজার কাজ নিয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷ আর চলতি মে পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আরব আমিরাতের মন্দা বাজার
শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল বাংলাদেশের বড় বাজার৷ ২০০৮ সালে দেশটিতে একবছরে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার জন বাংলাদেশি গেছেন৷ তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই বাজারটিতে মন্দা চলছে৷ গতবছর মাত্র তিন হাজার ৩১৮ জন দেশটিতে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেয়েছেন৷ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল আরব আমিরাত, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৮ ভাগের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/J. Schwenkenbecher
পড়তিতে ওমান
প্রবাসীদের গন্তব্যের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে পারস্য উপসাগরের দেশ ওমান৷ ১৫ লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে গেছেন সেখানে৷ তবে গত ৩ বছর ধরে এই বাজারটিতেও প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা কমছে৷ ২০১৬ সালে যেখানে এক লাখ ৮৮ হাজার জন ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন, গেল বছর তা নেমে এসেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জনে৷ আর চলতি বছর মে পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৪০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/A. Farnsworth
আকর্ষণীয় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশিদের কাছে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে৷ ২০০৭ সালে সেখানে সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের বেশি শ্রমিক কাজের জন্যে গেছেন এশিয়ার দেশটিতে৷ মাঝে এই প্রবণতা কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে দেশটিতে গেছেন প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার জন আর ২০১৯ এ মাত্র ৫৪৫ জন৷ সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: picture-alliance/FOTOGRAMMA/M. Alberico
সম্ভাবনার কাতার
২০০৬ সাল পর্যন্তও কাতারের বাজার বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন সেখানে অনেক বাংলাদেশির জন্যেই কাজের সুযোগ তৈরি করেছে৷ এখন পর্যন্ত আট লাখ ১১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance
দক্ষ শ্রমিকের বাজার সিঙ্গাপুর
দেশের দক্ষ শ্রমিকদের জন্য পছন্দের এক গন্তব্য সিঙ্গাপুর৷ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশটিতে এখন পর্যন্ত চাকরি নিয়ে ৭ লাখ ৯২ হাজার বাংলাদেশি পা রেখেছেন, যা মোট প্রবাসীর ছয় ভাগের কিছু বেশি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ হাজার জন গেছেন ২০১৩ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
কুয়েতে ৫ ভাগ
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে৷ ২০০৮ থেকে ২০১৩— এই সময়ে মাত্র ৪১৪ জন দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন৷ ২০১৪ সাল থেকে তা বাড়তে শুরু করলেও গত দুই বছর ধরে আবার পড়তির দিকে৷ সব মিলিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে, যা মোট প্রবাসীর প্রায় ৫ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
পারস্য উপসাগরের দ্বীপে
চার লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্যের দেশ বাহরাইন৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৭২ হাজার মানুষ কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পারস্য উপসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে৷ তবে ২০১৯ সালে গেছেন মাত্র ১৩৩ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
ইউরোপে সর্বোচ্চ ইটালিতে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ইটালিতে৷ ২০০২ সাল থেকে সেখানে পাড়ি জমানোর তথ্য আছে বিএমইটির কাছে৷ সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি বৈধ পথে গেছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশটিতে৷