লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো বহুমুখী ও দূরদর্শী প্রতিভা যদি আজকের ডিজিটাল যুগে বেঁচে থাকতেন, তাহলে কেমন হতো? একদল শিল্পী এমন সব পথিকৃতের সৃষ্টিকর্ম ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন রূপে তুলে ধরছেন৷
বিজ্ঞাপন
ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিখ্যাত শিল্পকর্ম উপস্থাপন
04:38
রেনেসাঁস যুগের সেরা শিল্পীদের মধ্যে রাফায়েল, মিকেলাঞ্জেলো ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চি অন্যতম৷ এবার ডিজিটাল প্রযুক্তি, অ্যানিমেশন ও আবহসংগীতসহ তাঁদের শিল্পকর্মগুলি নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা হচ্ছে৷
জার্মানির লাইপসিশ শহরের এক শিল্পকেন্দ্র ইটালির বিশ্ববিখ্যাত ভিডিও শিল্পী জানফ্রাংকো ইয়ানুৎসির সঙ্গে এক প্রকল্প শুরু করেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘রেনেসাঁস সে যুগে অত্যন্ত আধুনিক এক দিশা দেখিয়েছিল, যা তারুণ্যের বাতাস এনে শিল্পের জগতে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল৷ এই ধারা ধর্মীয় বিষয় ছেড়ে শিল্পকে বৈশ্বিক মোটিফের দিকে নিয়ে গিয়েছিল৷ তাই ফ্রেস্কো পেইন্টিং সে সময়ে স্থাপত্যের মধ্যে স্থান পেয়েছিল, যা তার আগে সম্ভব ছিল না৷ শিল্পের ক্ষেত্রে এত বড় পরিবর্তনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই আমরা এই ইনস্টলেশন সৃষ্টি করেছি৷''
জার্মানির ১০টি মনোমুগ্ধকর পুরনো শহর
পুরনো কাঠের কড়িবর্গা দেওয়া বাড়ি, নাকি গথিক বা রেনেসাঁস শৈলীর? জার্মানির বহু পুরনো শহর যেন তাদের অতীতকে ধরে রেখেছে৷ আর সে অতীত এতই সুন্দর যে কাকে ছেড়ে কা’কে দেখি?
ছবি: picture-alliance/Arco Images/R. Kiedrowski
ল্যুবেক
এই হানসিয়াটিক শহরটির সমুদ্রযাত্রার সঙ্গে যোগ অনেক দিনের৷ শহরের কেন্দ্রটিকে একটি দ্বীপের মতো করে ধরে রেখেছে ট্রাফে নদীর দুই শাখা৷ নদীটি গিয়ে পড়েছে বালটিক সাগরে৷ মধ্যযুগের শেষ দিকে বাণিজ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠে ল্যুবেক৷ বহু বাড়ি দেখলে সেই সমৃদ্ধির একটা আন্দাজ পাওয়া যায়৷ প্রায় ১,৮০০ বাড়ি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষিত৷ ল্যুবেকের পুরনো অংশটিকে ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যোগ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভিসমার
ল্যুবেকের মতো ভিসমারও একটি হানসিয়াটিক শহর৷ তবে ভিসমারের বালটিক সাগরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে৷ ভিসমারও রয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায়৷ ভিসমারে বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য হল তার তিনটি বড় গির্জা, বন্দর ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাড়ি, যেগুলির চুড়ো আর বার্নিশ করা লাল ইট দেখলেই তাদের চেনা যায় (যেমন ছবিতে)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Büttner
কোয়েডলিনবুর্গ
স্যাক্সনি-আনহাল্ট রাজ্যের কোয়েডলিনবুর্গ শহর ১৯৯৪ সাল থেকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায়৷ কাঠের কড়িবর্গা দেওয়া প্রায় ১,২০০টি পুরনো বাড়ি, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু সরু গলি, মাঝেমধ্যে আসে কোনো খোয়াবাঁধানো চত্বর – প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে কোয়েডলিনবুর্গে এই ধরনের বাড়িই তৈরি হয়েছে৷ আজ সেগুলো দেশ-বিদেশের পর্যটকদের দর্শনীয় বস্তু৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT Bildarchiv/R. Freyer
গ্যোরলিৎস
জার্মানির একেবারে পুবের শহর গ্যোরলিৎসে রেনেসাঁস, গথিক ও ব্যারোক, এই তিন ধরনের শৈলী পাশাপাশি পাওয়া যাবে৷ হয়তো সেই কারণেই শহরটি ‘লোকেশন’ হিসেবে হলিউডের এত প্রিয়: ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’, ‘গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল’ ও ‘গ্যোটে’র মতো ছবির শুটিং হয়েছে এখানে৷ ছবিতে কৃত্রিম তুষারসহ একটি ফিল্মের সেট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Trenkler
ফ্রিৎসলার
হেসে রাজ্য তার অসংখ্য ‘হাফ-টিম্বার্ড’ বাড়ি, অর্থাৎ কাঠের কড়িবর্গার বাড়ির জন্য বিখ্যাত৷ বাড়িগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার ও জনসাধারণ সচেষ্ট৷ এই বাড়িগুলির কাঠামো কাঠের, কিন্তু বাকি দেয়াল ও মেঝে কাদামাটির – তবুও বাড়িগুলো শক্তপোক্ত৷ ফ্রিৎসলারের বাজারের চত্বরটি চতুর্দ্দিকে ‘হাফ-টিম্বার্ড’ বাড়ি দিয়ে ঘেরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Zucchi
বামব্যার্গ
ঐতিহাসিক বামব্যার্গের কেন্দ্রে রয়েছে তার পুরাতন টাউন হল৷ শহরটির পরিচিতি চিহ্ন এবং পর্যটকদের ছবি তোলার প্রিয় মোটিফ৷ টাউন হলটি রেগনিৎস নদীর বুকে একটি কৃত্রিম দ্বীপের উপর নির্মাণ করা হয়৷ বামব্যার্গের ২,০০০টি সংরক্ষিত বাড়ির মধ্যে এই টাউন হলও পড়ে৷ শহরের পুরনো অংশ ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/P. Schickert
হাইডেলব্যার্গ
নেকার নদী, পুরনো ব্রিজ, দুর্গ আর শহরের পুরনো অংশ মিলিয়ে হাইডেলব্যার্গ ছিল রোম্যান্টিক যুগের রোম্যান্টিকদের কাছেও রোম্যান্টিক৷ গ্যোটে, হ্যোল্ডারলিন, হাইনে ও হেগেলের মতো স্বনামধন্য জার্মান কবি ও দার্শনিকরা হাইডেলব্যার্গকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করেছেন৷ আজও প্রায় এক কোটি বিশ লাখ টুরিস্ট প্রতিবছর হাইডেলব্যার্গে যান৷
ছবি: picture alliance/Daniel Kalker
রোটেনবুর্গ অব ডের টাউবার
পুরনো জার্মান শহর বলতে যা বোঝায়, বাভারিয়ার রোটেনবুর্গ শহরটি যেন তার পরাকাষ্ঠা৷ প্রাকার দিয়ে ঘেরা, আঁকাবাঁকা গলির দু’ধারে কাঠের কাঠামোর বাড়ি৷ শহরটির মধ্যযুগীয় কেন্দ্র সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে, তার চারপাশে দুর্গপ্রাকারের মতো প্রাচীরটি দিয়ে হেঁটে বেড়ানো যায়৷ আধুনিক সভ্যতার কোনো বাহ্য নিদর্শন চোখে পড়ে না৷ জার্মান পর্যটন শিল্পে যাকে ‘রোম্যান্টিক রোড’ বলা হয়, রোটেনবুর্গ তার একটি মূল আকর্ষণ৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT Bildarchiv/G. Knoll
পাসাউ
ইলৎস, ইন ও ড্যানিউব, এই তিনটি নদী এসে মিলেছে পাসাউ শহরে৷ ইন আর ড্যানিউবের মাঝে এক ফালি জমির ওপর পাসাউ-এর প্রাচীন অংশ – সপ্তদশ শতাব্দীর ব্যারোক শৈলীর কিছু অসাধারণ নিদর্শন৷ একাধিক গির্জা ও খ্রিষ্টীয় মঠ আছে এখানে, যার মধ্যে সেন্ট স্টিফেন্স ক্যাথিড্রাল সবার মাথা ছাড়িয়ে৷ এই ক্যাথিড্রালের অর্গানটি আবার বিশ্বের অন্য যে কোনো ক্যাথিড্রালের অর্গানের চেয়ে বড়৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT Bildarchiv/T. P. Widmann
ফ্রাইবুর্গ
ব্ল্যাক ফরেস্টের পাদদেশে ফ্রাইবুর্গ শহরটির ‘চার্ম’ আলাদা৷ বিশেষ করে শহরের পুরনো অংশে পথের ধারে যে ছোট ছোট নালাগুলো দিয়ে পানি বয়ে যায়, সেগুলি৷ এই নালাগুলো খুব সম্ভবত শহরের ময়লা পানি নিষ্কাশন প্রণালীর অঙ্গ ছিল৷ তবে মনে রাখবেন, এই নালার পানিতে পা দিলে নাকি শেষমেশ ফ্রাইবুর্গের কারুর সঙ্গে বিয়ে হয়!
এই মাল্টিমিডিয়া শো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি ‘ইমারসিভ আর্ট'-কে সম্বল করেছেন৷ এর আওতায় দর্শক ২৪টি বিমারের কল্যাণে ৮ মিটার উঁচু ভিডিও প্রজেকশনে ডুব দিতে পারেন৷ ফলে তুলির প্রত্যেকটি টান আলাদা করে চেনা যায়৷ জানফ্রাংকো ইয়ানুৎসি বলেন, ‘‘ভিডিও ও ধ্বনির এই মেলবন্ধনের মধ্যে এখনো নতুনত্ব রয়েছে বলে আমি মনে করি৷ এককালে ফটোগ্রাফি ও সিনেমার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল৷ এই দুই ক্ষেত্রেরও বিকাশ ঘটেছে এবং আমাদের উপলব্ধিরও পরিবর্তন ঘটেছে৷ এখন আর শুধু দেখলেই চলে না, সেই সঙ্গে ভারচুয়াল ও ধ্বনিগত উপলব্ধিও জরুরি৷''
শুরু থেকে সংগীতও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে৷ সাউন্ড আর্টিস্ট বা ধ্বনিশিল্পী লুকা লংগোবার্ডি সংগীত বেছে নিয়ে নতুন করে সাজান৷ লুকা বলেন, ‘‘আমি ডিজিটাল কাঠামো, অর্থাৎ কম্পিউটারেই বেশি কাজ করি৷ সেই শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করি, যাঁরা মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন৷ এই প্রদর্শনীতে আমার এক সংগীতসৃষ্টি রয়েছে, যা আসলে অর্কেস্ট্রার জন্য ভেবে করেছিলাম৷ ইনস্টলেশনে অবশ্য শুধু এক স্ট্রিং কোয়ার্টেট ও এক ডিজিটাল অর্কেস্ট্রা সংগীত পরিবেশনা করে৷ শুনলে মনে হবে আসল এক অর্কেস্ট্রা যেন গির্জার মধ্যে সংগীত পরিবেশন করছে৷''
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে রেনেসাঁস ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা নিজের ও জগত সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে দিয়েছে৷ রাফায়েল, মিকেলাঞ্জেলো ও বিশেষ করে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সৃষ্টিকর্ম সেই পরিবর্তনে বিশেষ অবদান রেখেছে৷ দা ভিঞ্চি-কে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিদ্বজনদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়৷ লুকা লংগোবার্ডি মনে করেন, ‘‘লিওনার্দো চিরকালই দূরদর্শী ছিলেন৷ তিনি এমন সব স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা তাঁর বিদায়ের পর আবিষ্কৃত হয়েছে৷ আজকের যুগে তিনি বেঁচে থাকলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনেক কিছু সৃষ্টি করতেন বলে আমার বিশ্বাস৷ হয়তো তিনি এখানে নতুন হলোগ্রাফিক উড়োজাহাজ প্রোজেক্ট করতেন৷''
এই প্রদর্শনী সবার আগে ফ্রান্সে দেখানো হয়৷ লাইপসিশ শহরের জন্য তার পরিবেশ নতুন করে সাজানো হয়েছে৷ লাইপসিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মার্কুস ল্যোফলার বলেন, ‘‘রেনেসাঁস যুগের সেরা ব্যক্তিত্বদের দিয়ে এই কর্মকাণ্ড সত্যি আমাকে নাড়া দিয়েছে৷ কিছু ক্ষেত্রে আবেগে চোখে পানি এসে গিয়েছিল৷ সেটাই শিল্পীদের লক্ষ্য ছিল৷ মানুষ শুধু ছবি দেখবেন, তাঁরা এমনটা আর চান না, বরং শিল্পকর্ম ও দর্শকের মধ্যে এক সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাই কাম্য৷''
দর্শকরা ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত ‘ইমার্সিভ আর্ট' দেখার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে পারেন, শিল্পকর্মের মধ্যে ডুব দিতে পারেন৷