1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভবেশের মৃত্যু : পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ছেলের মামলা

২১ এপ্রিল ২০২৫

দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় অবশেষে মামলা হয়েছে৷ মৃত্যুর তিনদিন পর পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন ভবেশের ছেলে স্বপন চন্দ্র রায়।

দিনাজপুরের বিরলে ভবেশ চন্দ্র রায়ের বাড়ি
মৃতের শরীরে দাগ দেখতে পেয়ে তাকে 'পরিকল্পিতভাবে হত্যা' করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন বলে জানিয়েছেন ভবেশ চন্দ্র রায়ের ছেলেছবি: Swapan Chandra Roy

সোমবার চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ৩-৪ জনকে আসামী করে বিরল থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন স্বপন। দিনাজপুর থেকে টেলিফোনে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, তার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে৷

বিরল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুস সবুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মামলা হিসেবে এজাহারটি গ্রহণ করা হয়েছে, এখন তদন্ত চলছে।”

মামলায় যে চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন, আতিকুল ইসলাম (৪০), রতন ইসলাম (৩০), মুন্না ইসলাম (২৭) ও মো. রুবেল (২৮)। ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্তদের মধ্যে আতিকুল ইসলাম বিরল থানার শহরগ্রাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব। রতন ইসলাম একই ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, মুন্না ইসলাম ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য এবং মো. রুবেল একই ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। ঘটনার পর তাদের এলাকায় দেখা গেলেও সোমবার দুপুরের পর থেকে তারা পলাতক।

বৃহস্পতিবার বিকালে ভবেশ চন্দ্র রায়কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে যাওয়ার পর জানানো হয় তিনি অসুস্থ৷ছবি: Swapan Chandra Roy

স্বপন চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, " (১৭.০৪.২০২৫, বৃহস্পতিবার) ঘটনার পর থেকে অভিযুক্তরা এলাকায় ছিলেন। দুপুরে আমি মামলা করার জন্য থানায় যাওয়ার পর থেকে তারা আর এলাকায় নেই। আমি মনে করি, বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। লাশ বাসায় আনার পর আমরা বাবার ঘাড়ে কালো দাগ দেখেছি। ফলে, আমরা মনে করছি, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথম দিকে মামলা করার সাহস পাচ্ছিলাম না, এলাকার মানুষের সাহসে মামলা করেছি।”

এজাহারে যা বলা হয়েছে

মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আতিকুল ইসলাম ও রতন ইসলাম এলাকায় সুদের বিনিময়ে মানুষকে টাকা দেন। এর মধ্যে আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে ভবেশ চন্দ্র রায় এক বছর আগে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নেন। প্রতি মাসে তার ৩ হাজার ২৫০ টাকা করে দেওয়ার কথা। সেভাবে তিনি পরিশোধও করে আসছিলেন। কিছু কিস্তি বাকি পড়েছে। এই দুইজনের সঙ্গে ভবেশ রায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল। গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দু'টি মোটরসাইকেলে অভিযুক্ত চারজন ভবেশ চন্দ্র রায়ের বাড়িতে যায়। এর মধ্যে রতন ইসলাম বাড়িতে ঢুকে ভবেশ রায়কে ডেকে আনেন। এক পর্যায়ে ভবেশ তাদের মোটরসাইকেলে করে বের হয়ে যান।

ওইদিন সন্ধ্যা পৌনে ৮টার দিকে রতন ইসলাম ভবেশ রায়ের ফোন থেকে কল দিয়ে স্বপনকে বলেন, তার বাবা অসুস্থ, স্বপন যেন গিয়ে ভবেশকে নিয়ে আসেন। স্বপন তার বাবাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করেন। পরে আবারও ফোন দেন রতন, তখনও একই কথা বলেন স্বপন। এরপর অভিযুক্তরা বাজারের পাশে একটি ভ্যানে ভবেশকে রেখে চলে যায়। এলাকার লোকজন তাকে উদ্ধার করে গ্রাম্য চিকিৎসক কৃষ্ণ কান্তের দোকানে নিয়ে যান। কৃষ্ণ কান্ত রক্তচাপ মেপে বলেন, রক্তচাপ ওপরে ৭০ এবং তিনি লক্ষ্য করেন ভবেশের শরীরের নিচের দিকটা নীল হয়ে গেছে। পরে কৃষ্ণ কান্তের পরামর্শে ভবেশকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়৷ সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারপর হাসপাতালে পোস্টমর্টেম করা হয় বলেও এজাহারে উল্লেখ করেছেন স্বপন রায়৷ সেই রাতেই বাসুদেবপুর এলাকার তুলাই নদীর পাশের শ্মশানঘাটে ভবেশ চন্দ্র রায়ের সৎকারকার্য সম্পন্ন করা হয়৷ ডয়চে ভেলেকে স্বপন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর ভয়ে তিনি অভিযোগ করেননি৷ সোমবার করা এজাহারে তিনি লিখেছেন, ‘‘উপরোক্ত বিবাদীরা আমার পিতাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে...৷''

ভবেশ রায়ের ছেলে স্বপন রায়ের অভিযোগ, তার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে৷ছবি: Md. Atiur Rahman

বিরল উপজেলা পূজা উৎযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন ভবেশ চন্দ্র রায়৷ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুবল রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃতদেহ বাড়িতে আনার পর পরিবারের সদস্যরা তার গলায় ও ঘাড়ে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। ফলে এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা যাবে না। এখন যেহেতু মামলা হয়েছে, ফলে সঠিকভাবে যেন তদন্ত হয় আমরা সেটাই চাই।”

ভবেশ চন্দ্র রায়ের জামাতা রঞ্জিত চন্দ্র রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার শ্বশুরকে তো বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। সুদে নেওয়া টাকার বিষয়ে ফুলবাড়ী বাজারে কথা কাটাকাটি হয়। তারপর নাড়াবাড়ি বাজারে নিয়ে মারধর করা হয়। এতে শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে আমার শ্যালককে ফোন দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে তারা। এরপর ফুলবাড়ী বাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।”

পুলিশের দাবি ‘স্বাভাবিক মৃত্যু'

দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হুসাইন ডয়চে ভেলের দাবি করেন, এখন পর্যন্ত তাদের কোনো তদন্তে ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তবে তিনি বলেন, এখন যেহেতু ছেলে মামলা করেছে, ফলে বিষয়টি নতুন করে তদন্ত হবে। পুলিশ সুপার আরো বলেন, ভবেশ রায় যাদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন তারা তার পূর্ব পরিচিত এবং তিনি স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়েছিলেন৷ কেউ ভবেশকে নির্যাতন করেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি বলেও দাবি দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হুসাইনের।

তারা তো প্রথমে ময়না তদন্তই করতে চায়নি: মো. মারুফাত হুসাইন

This browser does not support the audio element.

মৃতের ছেলের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, "তারা তো প্রথমে ময়না তদন্তই করতে চায়নি। আমি তাদের বুঝিয়ে ময়না তদন্ত করিয়েছি। এখন তাদের স্বজনের অভাব নেই। অনেকেই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে মামলা হয়েছে, তদন্ত হবে এবং যা পাওয়া যাবে সেটা রিপোর্টে উল্লেখ করা হবে।''

মৃত্যু ঘিরে ভারত-বাংলাদেশ বিতর্ক

ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এটিকে ‘পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড' হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখপাত্র তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারতের দাবি এ ঘটনার সাথে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের যোগসূত্র আছে। তবে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বা নির্যাতনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

শনিবার সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল লিখেন, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন নেতার ‘অপহরণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড' তাদের দৃষ্টিতে এসেছে। তিনি দাবি করেন, "বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর পদ্ধতিগত নির্যাতনের যে প্যাটার্ন, সেটিকে অনুসরণ করেই এ ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আগে এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, কোনো ক্ষমা বা অজুহাত ছাড়াই হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দায়িত্ব সম্পর্কে তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

ভারত সরকারের দিক থেকে এ ধরনের অভিযোগ আসার পরপরই তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিক্রিয়া আসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসসকে বলেন, "আমরা এই ভিত্তিহীন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করছি৷” শফিকুল আলম বলেন, (ভবেশ চন্দ্র রায়ের) ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবুও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে ভিসেরা বিশ্লেষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শফিকুল আলম বলেন, "দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর ‘সংগঠিত নিপীড়নের ধারাবাহিকতার' অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।” এ ঘটনা নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক' বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

প্রথম দিকে মামলা করার সাহস পাচ্ছিলাম না: স্বপন চন্দ্র রায়

This browser does not support the audio element.

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উদ্বেগ

বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এক বিবৃতিতে দিনাজপুরের বিরলে ভবেশ চন্দ্র রায়ের হত্যা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শিক্ষক কান্তিলাল আচার্যকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা, রাঙ্গামাটির কাউখালীতে মারমা তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনাসহ সারা দেশের অব্যাহত সাম্প্রদায়িক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, গত মার্চ মাসে সারা দেশে প্রায় অর্ধশত সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, মন্দিরে হামলা, ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার, আদিবাসীদের ওপর হামলা, বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। বিবৃতিতে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিত্রয় ঊষাতন তালুকদার, নিম চন্দ্র ভৌমিক ও মি. নির্মল রোজারিও এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও অস্থিরতার মধ্যে এই ঘটনাসমূহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাঝে আরো উদ্বেগ ও শঙ্কা সৃষ্টি করবে। দুর্বৃত্তদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা।

ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ভবেশ চন্দ্র রায়ের ছেলের অভিযোগের পর এখন তো কোনোভাবেই এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা যাবে না। আমরাও মনে করি, এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। বরং এটা একটা হত্যাকাণ্ড। আমরা সরকারের কাছে দাবি করবো, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হোক। পাশাপাশি ওই পরিবারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ