দিল্লিতে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের দাবি পেশ করেছেন আম আদমি পার্টি৷ মুখ্যমন্ত্রী হবেন দলের প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ শপথ গ্রহণ সম্ভবত ২৬ ডিসেম্বর৷ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালন করাই হবে পার্টির প্রধান চ্যালেঞ্জ৷
বিজ্ঞাপন
সব জল্পনার অবসান শেষে নির্বাচনি রায়ের ১৫ দিন পর কংগ্রেসের হাত ধরে দিল্লির মসনদে বসতে চলেছে আম আদমি পার্টি, সংক্ষেপে আপ৷ ভঙ্গুর রায় নিয়ে প্রথম দিকে কংগ্রেস ও বিজেপি কোনো দলই সরকার গঠনে আগ্রহ দেখায়নি৷ এই প্রথমবার নির্বাচনে নেমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসন নিজের ঝুলিতে ভরে দিল্লির রাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন শক্তিরুপে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে এই দল৷ মুখ্যমন্ত্রী হবেন দলের সর্বাধিনায়ক আন্না হাজারের একদা ভাবশিষ্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ শপথ গ্রহণ সম্ভবত আগামী ২৬ ডিসেম্বর রামলীলা ময়দানে৷
কে এই কেজরিওয়াল? ৪৪ বছর বয়সি কেজরিওয়ালের জন্ম দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানায়৷ পাদপ্রদীপে আসেন ২০১১ সালে যখন তিনি গুরু আন্না হাজারের সঙ্গ ত্যাগ করে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন৷ শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি খড়গপুর আইআইটি থেকে পাস করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার৷ কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন সর্বভারতীয় রাজস্ব বিভাগে৷ পরে স্বেচ্ছায় অবসর নেন৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
সরকার গঠন করবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কেজরিওয়াল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের এক অভিনব পন্থা অনুসরণ করেন৷ সোস্যাল নেটওয়ার্কিং, এসএমএস, ফোন এবং সভা করে ভোটারদের মত জানতে চাইলে তাঁদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ সরকার গঠনের পক্ষে রায় দেন৷
ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ
প্রশাসনিক দিক থেকে অনভিজ্ঞ আম আদমি পার্টির সামনে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ৷ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক৷ নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি পার্টির ইশতেহারে ছিল তা পূরণ করা কেজরিওয়ালের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷ যেমন দুর্নীতি নির্ভর কর্ম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জনলোকপাল আইন প্রণয়ন৷ তাঁর মতে, সম্প্রতি সংসদে পাস হওয়া লোকপাল বিল যথেষ্ট নয়৷ ঐ আইনে দুর্নীতি দূর হবে না৷ দুর্নীতিবিরোধী আইন আরো কঠোর করা জরুরি৷ দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য দরকার গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার শুদ্ধিকরণ এবং দায়বদ্ধতা৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমলা-রাজনীতিকদের অশুভ আতাঁত কেজরিওয়াল সরকার কতটা ভাঙতে পারবেন, সেবিষয়ে সংশয় আছে৷
অন্যদিকে কংগ্রেসের সমর্থন নিঃশর্ত নয়, ইস্যু-ভিত্তিক৷ তাই প্রতিপদে ঝুঁকি থাকছে৷ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হবে৷ সেক্ষেত্রে কেজরিওয়ালের সাফল্য পরনির্ভর৷ এটাই জোট রাজনীতির বাস্তবতা৷ এছাড়া প্রতিটি বড় সিদ্ধান্তের জন্য বারংবার গণভোট নেয়াটা নীতি হিসেবে ঠিক হলেও বাস্তবে অসুবিধা আছে৷ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, জনলোকপাল ছাড়াও মহিলাদের নিরাপত্তা, তারজন্য বিশেষ বাহিনী গঠন, পরিবার পিছু দৈনিক ৭০০ লিটার জল বিনামূল্যে সরবরাহ করা, বিদ্যুতের দাম অর্ধেক করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নতি করা ইত্যাদি৷ বিশেষজ্ঞদের মত হলো, স্থানীয় ইস্যু যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জল ইত্যাদির মতো স্থানীয় সমস্যাগুলির সমাধান আম আদমি সরকার করতে পারলেও মুদ্রাস্ফীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, রাজস্ব ঘাটতি ইস্যুগুলির সমাধান কেজরিওয়ালে হাতের বাইরে৷ তবে এটা ঠিক আম আদমি পার্টি আগামী বছরের সংসদীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে একটা দৃষ্টান্তমূলক নজির রাখতে চেষ্টার কসুর করবেন না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷