আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলনে নামবে তৃণমূল। লোক আসছে কলকাতা থেকে।
বিজ্ঞাপন
সোমবার রাজধানীতে বিরাট আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তৃণমূলের অঘোষিত দুই নম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও শেষ মুহূর্তে তাকে পরিকল্পনায় কিছু বদল আনতে হচ্ছে। কারণ আস্ত একটি ট্রেন ভাড়া করে কর্মীদের দিল্লিতে আনার কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রেল তৃণমূলকে সেই স্পেশাল ট্রেন দিচ্ছে না। যা নিয়ে রেলের সঙ্গে নতুন করে বিবাদ শুরু হয়েছে তৃণমূলের। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, রাজ্যের সমস্ত এমপি, এমএলএ এবং পঞ্চায়েত প্রধানেরা এই আন্দোলনে অংশ নেবেন। ২ এবং ৩ অক্টোবর দিল্লির রাজপথে এই আন্দোলন হবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলে। কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে ন্যায্য টাকা দেয় না, অভিযোগ এমনই।
অভিযোগ নতুন নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের প্রায় সমস্ত পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীরাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলেন। বস্তুত, এর আগে পশ্চিমবঙ্গে যখন বামেদের শাসন ছিল, তখনো কেন্দ্রের তৎকালীন সরকারগুলির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ বারংবার তুলেছে রাজ্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের অন্য রাজ্যগুলিও মাঝেমধ্যেই এমন অভিযোগ তোলে।
কেন্দ্র আবার অভিযোগ করে, রাজ্য কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেয় না। কেন্দ্রের টাকা ফেরত যায়। চক্রবৎ এই অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ইতিহাসের কালস্রোত বেয়ে চলতে থাকে।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিরোধী জোটের আসন সমঝোতা
ভারতের প্রধান বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার তৃতীয় বৈঠক চলছে মুম্বইতে। ২৮ দলের ৬৩ জন নেতা বৈঠকে উপস্থিত।
ছবি: Indian National Congress
পাটনা, বেঙ্গালুরুর পর মুম্বই
প্রথম বৈঠক হয়েছিল পাটনায়। তারপর বেঙ্গালুরুতে জোটের নাম ঠিক হয়, ইন্ডিয়া। ২৮টি দল একজোট হয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবার মুম্বইতে জোটের তৃতীয় বৈঠকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। উপরের ছবিটি বেঙ্গালুরু বৈঠকের।
ছবি: Bihar state Chief Minister's Office/AP/picture alliance
আসন বন্টন নিয়ে সিদ্ধান্ত সেপ্টেম্বরেই
ঠিক হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জোট শরিকেরা নিজেদের মধ্যে আসন বন্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলবেন। এনিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু কথা হয়েছে পাটনা ও বেঙ্গালুরুর বৈঠকে। বৃহস্পতিবার মুম্বইতে ঠিক হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা আসন বন্টন শেষ করে ফেলবেন।
ছবি: MOHAN KUMAR/AFP
রাহুল-অভিষেক কথা
মুম্বই যাওয়ার আগে দিল্লি এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার ভোরে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন অভিষেক। তাদের মধ্যে এক ঘণ্টা ধরে কথা হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়েই কথা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ও আসন বন্টনের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে।
ছবি: Congress Party/AP Photo/picture alliance
অধীর যা বলেছেন
লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আগে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ হলো পুকুর, আর দেশের রাজনীতি হলো নদী। কংগ্রেস এখন নদী নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তবে অধীর এখনো রাজ্যে তৃণমূল ও মমতার কড়া সমালোচনা করছেন। দত্তপুকুর বিস্ফোরণ নিয়েও করেছেন।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
কংগ্রেস যেখানে প্রধান বিরোধী
মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কেরালা, হরিয়ানা, ত্রিপুরা, গোয়ার মতো কিছু রাজ্যে লড়াইটা সরাসরি বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে। কংগ্রেস এখানে মূল বিরোধী দল। সেখানে অন্য বিরোধী দলের শক্তি খুব বেশি নয়। ফলে সেখানে সামান্য কিছু আসন তাদের ছাড়তে হতে পারে কংগ্রেসকে। কিন্তু দিল্লি নিয়ে সমস্যা আছে। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেস জোট করে লড়বে কি না, তা নির্ভর করছে, কেজরিওয়াল ও রাহুল গান্ধীর উপর।
ছবি: Pradeep Gaur/SOPA/Zuma/picture alliance
কংগ্রেস যেখানে ক্ষমতায়
ছত্তিশগড়, রাজস্থান, কর্ণাটক, হিমাচলে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে রাজস্থান, কর্ণাটকে আপ আসন চাইতে পারে। তবে দুই রাজ্যেই তাদের শক্তি খুবই কম। এনসিপি কিছু আসনের দাবিদার। ফলে এখানেও খুব বেশি আসন ছাড়তে হবে না কংগ্রেসকে। উপরের ছবিটি কর্ণাটকে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার।
ছবি: IANS
মহাজোটের রাজ্যে
মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ুতে মহাজোট আছে। কংগ্রেস তার শরিক। এই রাজ্যগুলিতেও আসন বন্টন নিয়ে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উপরের ছবিতে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ ও রাবড়ি দেবী। বিহারের মহাজোটে আছে কংগ্রেসও।
ছবি: Santosh Kumar/Hindustan Times/IMAGO
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে সমস্যা আছে। সেখানে সমাজবাদী পার্টি প্রধান বিরোধী দল। তারা এখনো পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে চায় না। সেক্ষেত্রে আসন সমঝোতা হবে নাকি দুই দল কৌশলগত সমঝোতা করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ছবি: Samiratmaj Mishra/DW
বামেরা কী করবে?
সিপিএম জানিয়ে দিয়েছে, তারা পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় কোনো জোটে যাবে না। তারা জাতীয় স্তরে জোটে থাকবে। এই অবস্থান বদলের সম্ভাবনা কম। পশ্চিমবঙ্গে তারা আইএসএফের সঙ্গে সমঝোতায় আছে। কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে। কেরলে তারা ক্ষমতায়। সেখানে তারা বা কংগ্রেস কেউই জোটে যেতে রাজি নয়।
ছবি: Sandip Saha/Pacific Press/picture alliance
অন্য রাজ্যে
তেলেঙ্গানায় লড়াইটা হবে টিআরএসের সঙ্গে কংগ্রেসের। তবে অন্ধ্রে লড়াই হওয়ার কথা ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সঙ্গে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশমের। নাইডু বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি আলাদা। সেখানে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল। দু-একটা রাজ্যে তৃণমূল আছে। আছে কিছু আঞ্চলিক দলও। উপরের ছবিতে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও।
ছবি: Ians
জোটের মুখ
জোটের মুখ হিসাবে আগে থেকে কাউকে তুলে ধরা হবে না। তাহলে লড়াইটা মোদী বনাম তার বিরুদ্ধে হবে। বিরোধী নেতারা চাইছেন, লড়াইটা এনডিএ বনাম ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে হোক। তবে জোটের আহ্বায়ক হিসাবে নীতীশ কুমার ও মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম শোনা যাচ্ছে।
ছবি: Bihar Chief Ministers Office/AP/picture
কংগ্রেস চাইছে
সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী এবার এই জোট নিয়ে চলতে চান। তাই খুব ভেবেচিন্তে প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, বিরোধের জায়গাগুলিকে সরিয়ে রেখে যে সব বিষয়ে মতৈক্য হতে পারে, সেই জায়গাগুলি বেছে নিতে।
ছবি: Manjunath Kiran/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
তৃণমূলের নেতারা, এমপি-রা আগেও দিল্লিতে এই অভিযোগ নিয়ে আন্দোলন করেছেন। অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন। তাদের করার অধিকার আছে, কারণ, তারা পার্লামেন্টের সদস্য। কিন্তু আগামী আন্দোলনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে পরিকল্পনা করেছেন, তা অভূতপূর্ব। রাজ্যের সমস্ত এমএলএ এবং পঞ্চায়েত প্রধানদেরও তিনি দিল্লিতে নিয়ে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরো মানুষকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা তাদের ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত পরিকল্পনা কিছুটা ছোট করতে হয়েছে। অভিষেককে ৩ অক্টোবর ইডি ফের তলব করেছে। অভিষেককে ৩ অক্টোবর ইডি ফের তলব করেছে। ২ তারিখ দিল্লি থাকলেও ৩ তারিখ তিনি দিল্লিতে বিক্ষোভে না-ও থাকতে পারেন। উপরন্তু ট্রেন না পাওয়ায় সকলকে দিল্লি আনা যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে অভিষেকের দিল্লিতে এসে এই আন্দোলন যে একটি রাজনৈতিক চমক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন আন্দোলনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার এবং তার দলের। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, 'ইন্ডিয়া'র শরিকদের তিনি এই আন্দোলনে শামিল করতে পারছেন না কেন? এখনো পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে, ইন্ডিয়া জোটের কোনো দলই তৃণমূলের এই আন্দোলনে থাকছে না। স্বয়ং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও নন। কংগ্রেসের জাতীয় নেতারাও নন। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতেই কি রাজ্য থেকে লোক 'ভাড়া' করে আনতে হচ্ছে অভিষেককে?
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এমনই এক বিরোধী জোট তৈরি হয়েছিল। অ-কংগ্রেসি ও অ-বিজেপি সেই জোটের অন্যতম নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লির কুর্সি দখলের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় দিল্লির রামলীলা ময়দানে আন্না হাজারের ঐতিহাসিক আন্দোলন চলছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সেখান থেকেই তার রাজনীতিতে উত্থান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মঞ্চে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। মনে করা হয়েছিল, ওই মঞ্চ থেকেই জাতীয় নির্বাচনের মুখ হয়ে উঠবেন মমতা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছিল, মমতার সভায় মাছি তাড়ানোরও লোক ছিল না। সভার পরিস্থিতি দেখে আন্না হাজারেও শেষপর্যন্ত সভায় আসেননি।
ইতিহাসের সেই পাঠ মনে রেখেই কি ঠিক দশ বছর পর ট্রেন ভাড়া করে লোক এনে দিল্লির মঞ্চ ভরাতে চাইছেন অভিষেক? এত কিছুর পরেও ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের ভরসা করতে পারছেন না? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর তত সহজ নয়।