রাজধানী দিল্লিতে মহিলাদের নিরাপত্তার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর দু'দিনের ধরনা তুলে নিলেও, সে সময় দিল্লিবাসীদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, জনজীবন যেভাবে অচল হয়ে পড়ে, তাতে ঐ ধরনার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে৷
বিজ্ঞাপন
মহিলাদের নিরাপত্তার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের ধরনায় জনজীবন একেবারে নাকাল৷ দিল্লির স্পর্শকাতর রাজপথ সংলগ্ন সংসদ ভবন এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর চত্বরে, বিশেষ করে আর কয়েকদিন পরে যেখানে হবে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের শোভাযাত্রা, সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরণের ধরনা কতটা সমর্থনযোগ্য – তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷ বিশৃঙ্খলা, লাঠিচার্জ, ব্যারিকেড, জনতা-পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ – কী নয়? আহত হন ৩০ জনের মতো৷ তার মধ্যে মিডিয়ার লোকজনও আছেন৷ এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে৷ আর দিল্লি পুলিশকে ঐ ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেছেন দিল্লির এক আদালত৷
অ্যানার্কিস্ট বা নৈরাজ্যবাদীর তকমা পরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের এই ধরনার ঔচিত্য ও অনৌচিত্য নিয়ে জনসমাজে বিতর্ক তুঙ্গে৷ বিজেপির শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলির মন্তব্য, আম আদমি পার্টির চমকদারি জনমোহিনী রাজনীতি এখন নৈরাজ্যবাদের রাজনীতি এসে ঠেকেছে৷ দিল্লি সরকারের বিরোধী এক দলনেতা মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল যেভাবে দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা দু'দিন ধরে অবরুদ্ধ করে রাখলেন তা নজীরবিহীন৷ এটাকে গণতন্ত্র বলে না৷ রাস্তার রাজনীতি নৈরাজ্যবাদ ছাড়া আর কী? সহযোগী দল হয়েও সমালোচনা করতে ছাড়েনি কংগ্রেসও৷ তবে সমর্থন তুলে নেবার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি৷ দিলে আখেরে লোকসান হবে কংগ্রেসেরই৷ সংসদীয় নির্বাচনের মুখে দিল্লি সরকারকে ফেলে দিলে তার দায় বর্তাবে কংগ্রেসের ওপর৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
নৈরাজ্যবাদীর তকমাটা অবশ্য প্রথমে কেজরিওয়ালকে দিয়েছিল কংগ্রেস৷ তৃণমূল কংগ্রেস মনে করে, কেজরিওয়াল নিজেকে অ্যানার্কিস্ট হিসেবে দেখাতে চাইলে তাঁর ইস্তফা দেয়া উচিত৷ আম আদমি পার্টির সমর্থকরা পাল্টা আঙুল তুলে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজে কি রাস্তার রাজনীতি করেননি? আম জনতার একাংশের মতে, শৃঙ্খলা রক্ষা করাই যদি পুলিশের কাজ হয়, তাহলে পুলিশের নাকের ডগায় ড্রাগ আর যৌন ব্যবসা চলে কী করে? এর বিরুদ্ধে সরকার আওয়াজ তুললে সেটা পুলিশের কাছে বিশৃঙ্খলা৷ যেহেতু পুলিশ কেন্দ্রের অধীন৷ যখন সাধারণ মানুষ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন এক শ্রেণির মানুষ তাঁর সমালোচনায় মুখর৷
প্রশ্ন হচ্ছে দিল্লি সরকারের প্রধান হয়ে কেন তাঁকে বিক্ষোভ দেখাতে রাজপথে ধরনায় বসতে হলো? কয়েকদিন আগে দিল্লি সরকারের আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী দিল্লির এক পাড়ায় আফ্রিকার কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে ড্রাগ ও দেহ ব্যবসার অভিযোগ তুলে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন৷ কিন্তু পুলিশ কান দেয়নি৷ বলেছে বিনা ওয়ারেন্টে বাড়ি তল্লাসি করা যায় না৷ তখন মন্ত্রী এবং তাঁর দলবল মধ্যরাতে জোর করে বাড়িতে ঢুকে উগান্ডার এক মহিলাকে হেনস্থা করেছেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন ঐ মহিলা৷ এর প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে আফ্রিকান দেশগুলির রাষ্ট্রদূতদের আশ্বস্ত করা হয় যে, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ সরকার ভবিষ্যতে এবিষয়ে কড়া নজর রাখবেন৷ ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূত মনে করেন, বিনা ওয়ারেন্টে দেশের বা বিদেশের কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার করা যায় না৷ দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকারের আইনমন্ত্রী যেটা করেছেন, তা গণতন্ত্রে চলতে পারে না৷ দিল্লির আইনমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি আসছে বিভিন্ন নারী সংগঠন এবং মহিলা কমিশনের কাছ থেকে৷