দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক কোন পথে যাবে?
৮ জানুয়ারি ২০১৯শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় নতুন দিল্লির উৎফুল্ল হবার যথেষ্ট কারণ আছে৷ আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থর্নৈতিক, বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা আরো সুদৃঢ় করতে নতুন দিল্লি এবং ঢাকা একে অপরের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দেবে সন্দেহ নেই৷ আরো বেশি বন্দর, সড়ক যোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ জলপথ এবং উপকূলবর্তী নৌ-চলাচল অনেক বাড়বে. মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য বন্দরের সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করবে ভারত. কারণ, উভয় দেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে এটা জরুরি৷ ভারতের দিক থেকে তো বটেই৷ বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় ভারতের উপস্থিতি আরো বেশি দরকার৷ হ্যাঁ, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনছে, যেটা দিল্লির সরকারি মহলের একাংশের মনঃপুত হয়নি৷ কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিপত্তি মুছে ফেলা কখনোই সম্ভব নয়৷ মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধি ভারতের স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করছন রাজনৈতিক তথা স্ট্র্যাটিজিস্টরা৷ সেটা বেশ বুঝতে পেরেছেন শেখ হাসিনা এবং কাজে লাগিয়েছেন তিনি৷ দিল্লির মসনদে যে সরকারই এসেছে, ঢাকার দিকে সানন্দে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ একদিকে ভারত নিরাপত্তা ইস্যুতে যেমন ঢাকার সাহায্য পেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ পেয়েছে উন্নয়ন অ্যাজেন্ডায় নতুন দিল্লির সহায়তা৷ গড়ে উঠেছে পারস্পরিক লেনদেনের একটা সুষ্ঠু রোডম্যাপ৷
এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বিগত পাঁচ বছরে একটা ভালো জায়গাতেই ছিল৷ তার মূল কারণ, সন্ত্রাস দমন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের হাত ধরে সূক্ষ্মভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে ভারতের সমাধানসূত্র খুঁজে বার করা৷ এই দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে দুদেশের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ এছাড়াও ভারত ও বালাদেশের মধ্যে যৌথ নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল৷ মনে হয়, শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগামী পাঁচ বছরে আরো সুদৃঢ় হবে৷ কারণ, জামাত ও উগ্রবাদী যেসব সংগঠন বাংলাদেশের মাটিতে ইতিমধ্যেই মাথা চাড়া দিয়েছিল, সেগুলি নির্মূল করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং আগামী দিনেও করবেন৷ সেখানে হাসিনা সরকার ভারতের কাছ থেকে এবং ভারত হাসিনা সরকারের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবে, বলাই বাহুল্য৷'' সার্বিকভাবে নাগরিক সমাজ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা, মুক্তভাবনা এবং গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে দ্বিপাক্ষিক যৌথ উদ্যোগ আগামী পাঁচ বছরে সুনির্দিষ্ট পথেএগিয়ে যাবে বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি৷
ভারতেও সাধারণ নির্বাচন আসন্ন৷ সুতরাং যে দলই সরকারে আসুক বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক কি একই পথে চলবে ? ডয়চে ভেলের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘ভারতে একটা গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো আছে৷ সেটা অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা৷ কাজেই যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং মিয়ানমারে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং শ্রীলংকার ওপর চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি আটকাতে এবং ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে বাংলাদেশের হাত ধরা ছাড়া ভারতের গত্যন্তর নেই৷ ভারতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে যে দলই আসুক বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতেই হবে৷ সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকেই যাবে৷''
রোহিঙ্গা ও তিস্তা জলবণ্টন ইস্যুর সুরাহা কি হবে? জবাবে অধ্যাপক লাহিড়ি বললেন, ‘‘রোহিঙ্গা ইস্যুর সুরাহা করতে ভারত অন্যভাবে চেষ্টা করছে৷ কিন্তু তিস্তা জলবণ্টন ইস্যু জাতীয় স্তরে সুরাহা করার পথে বাধা নেই আমরা জানি৷ এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সঙ্গে নিয়ে যদি এর সমাধানসূত্র খুঁজে পাবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সহযোগিতার ভিতটা আরো অর্থবহ হয়ে উঠবে৷ নীতিগতভাবে তিস্তা জলবণ্টনে কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে যে আপত্তি নেই, সেই বার্তাটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে আরো দ্ব্যর্থহীনভাবে পৌঁছে দিতে হবে৷ কাজেই ভারতের আসন্ন নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, দুই দেশের সম্পর্ক সুনির্দিষ্ট পথেই চলবে৷''
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে নির্ভরযোগ্য বিরোধী দলের উপস্থিতি দরকার৷ না হলে আগামী পাঁচ বছরে একটা দমবন্ধকর বাতাবরণ তৈরি হতে পারে, হাসিনা সরকারের নিরপেক্ষতার স্খলন ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ ঢাকা-দিল্লির ভবিষ্যৎ আলোচনায় এটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার৷ অন্যদিকে কক্সবাজার এলাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একটা উগ্রপন্থি গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে৷ এরা তলে তলে হাত মেলাচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধী দল কিংবা আইএসআই বা আল-কায়দার সঙ্গে, যেটা উভয় দেশের পক্ষেই দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা৷ চীন বা ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেবার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর যতটা চাপ দেওয়া উচিত ছিল তা দেয়নি৷ ভারত শুধু মানবিক সাহায্য দিয়েই খালাস৷ হয়ত জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবেই৷ অবশ্য মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বভূমি রাখাইন প্রদেশের পরিকাঠামো উন্নয়নেও ভারত সাহায্য করছে, যাতে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সম্মত হয়৷
বিশ্বের বহু দেশের সরকার এবং নাগরিক সমাজ শেখ হাসিনার সাফল্যের আশায় তাকিয়ে আছে৷ চতুর্থ বারের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বর্ধিত দায় বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন থাকবেন, এটাই আশা৷