বুধবার সকাল সাতটা থেকে শুরু হয়েছে দিল্লি বিধানসভার ভোটগ্রহণপর্ব। দিল্লিতে উৎসবের আবহে ভোট হয়। এবারো হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ কি পরপর তৃতীয়বার একার ক্ষমতায় দিল্লিতে সরকার গঠন করতে পারবে, নাকি নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের চেষ্টা সফল হবে এবং দিল্লি বিধানসভায় আবার বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে? কংগ্রেস কি অন্তত একটা আসন পলাবে? বুধবার এই সিদ্ধান্ত নেবেন দিল্লির ভোটদাতারা। ফলাফল জানা যাবে আট ফেব্রুয়ারি।
দিল্লিতে ভোটের প্রচার থেকে ভোটগ্রহণপর্ব পুরোটাই সাধারণত খুবই নিরুত্তাপ হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করলে দিল্লির ভোটকে নিস্তরঙ্গ লাগবে। বুথেও চাপা উত্তেজনা নেই। বুথের বাইরে কোনো মারামারি সচরাচর হয় না। আপ ও বিজেপি-র মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও তার প্রতিফলন কর্মীদের মধ্যে সচরাচর পড়ে না।
সকাল থেকেই দিল্লির বুথগুলিতে ভোটদাতারা ভিড় জমিয়েছেন। দিল্লিতে সাধারণত বেলা দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ভালো ভোট পড়ে। আবার বিকেলের দিকে মানুষ ভোট দিতে যান। দুপুরের দিকে খুব বেশি মানুষ বুথ-মুখি হন না। এবারও সকালের দিকে বুথে মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
সকাল নয়টা পর্যন্ত নয় শতাংশ ভোট পড়েছে।
কী বলছে রজনৈতিক দলগুলি
বাঙালিপ্রধান চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকার ছবিটাও একই। বিজেপি নেতা সলিল নন্দী ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''এবার পুলিশ একটু বেশি কড়াকড়ি করছে। আগে বুথকর্মীরা মোবাইল সুইচ অফ করে নিয়ে যেতেন। এবার তাদের মোবাইল নিয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না।''
আপ নেতা অনুপ ঠাকুর ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''সকাল থেকে উৎসবের আমেজেই ভোট হচ্ছে। দিল্লির ঐতিহ্য বজায় থাকছে। চিত্তরঞ্জন পার্কে সকাল থেকে মানুষ বুথে আসছেন। ভোট দিচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন। তবে খুব বেশি লাইন হচ্ছে না।''
ভোট দিলেন রাষ্ট্রপতি
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিলেন। ভোট দিয়েছেন ভারতের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না।
দিল্লিতে এবার ত্রিমুখি লড়াই। আপ, বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সাবেক উপ মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কেজরিওয়াল দিল্লি-জুড়ে প্রচারের ঝড় তোলার চেষ্টা করেছেন।
দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপ, বিজেপি, কংগ্রেস যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে
আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচন। আপ, বিজেপি, কংগ্রেস দিল্লির মানুষের জন্য ঢালাও জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দিল্লিকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে বড় কোনো পরিকল্পনার ঘোষণা নেই।
ছবি: Manish Swarup/AP Photo/picture alliance
মেয়েদের মাসে দুই হাজার একশ টাকা দেবে আপ
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দিল্লিতে তারা আবার ক্ষমতায় এলে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি মেয়েদের প্রতি মাসে দুই হাজার একশ টাকা করে দেবে। তবে যে নারীরা আয়কর দেন না, তাদেরই টাকা দেয়া হবে। আপ এর নাম দিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মহিলা সম্মান যোজনা। তারা ভোট ঘোষণার আগে শিবির করে নারীদের নামও নথিভুক্ত করেছে।
ছবি: Raj K Raj/Hindustan Times/Sipa USA/picture alliance
পূজারি গ্রন্থি সম্মান যোজনা
আপ জানিয়েছে, তারা মন্দিরের পূজারি ও গুরুদ্বারের গ্রন্থিদের মাসে ১৮ হাজার টাকা করে দেবে। আপ নেতা অনুপ ঠাকুর ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''মসজিদের ইমামরা আগে থেকেই প্রতি মাসে টাকা পান। তাই তাদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি।'' দিল্লিতে ওয়াকফ বোর্ড ইমামদের টাকা দেয়। ওয়াকফ বোর্ড দিল্লি সরকারের অধীনে কাজ করে। তবে এর জন্য সরকারের অর্থ খরচ হয় না. ওয়াকফ বোর্ডের নিজের আয় থেকে টাকা দেয়।
দিল্লির অটোচালকদের জন্য ১০ লাখ টাকার জীবনবিমা এবং পাঁচ লাখ টাকার দুর্ঘটনাবিমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আপ। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, অটোচালকদের মেয়ের বিয়েতে এক লাখ টাকা দেয়া হবে। তাদের স্কুলে ইউনিফর্ম কেনার জন্য আড়াই হাজার টাকা দেয়া হবে। আপ-কে প্রথম থেকেই অটোচালকরা সমর্থন করেছে। প্রথম থেকেই ভোটের সময় অটোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করে আপ। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিনা পয়সায় হাসপাতালে চিকিৎসার কথাও বলেছে আপ।
ছবি: Getty Images/AFP/X. Galiana
স্কুল পড়ুয়াদের জন্য
আপের প্রতিশ্রুতি, তারা ক্ষমতায় এলে স্কুলের ছাত্ররা সরকারি বাসে বিনা পয়সায় চড়তে পারবে। মেট্রোতে তারা অর্ধেক ভাড়ায় চড়তে পারবে। দিল্লিতে নারীরা এখন বিনা পয়সায় বাসে চড়ার সুয়োগ পান। সেটাও চালু থাকবে। এছাড়া আম্বেডকর সম্মান স্কলারশিপ যোজনাও চালু করার কথা বলেছে আপ। এর ফলে দিল্লির পড়ুয়ারা স্কলারশিপ ও বিদেশে পড়ার সুযোগ পেলে তাদের ফি, থাকা ও যাতায়াতের খরচ সব সরকার বহন করবে।
ছবি: Courtesy/M Ansari
ভাড়াটেদের জন্য
আপ-এর প্রতিশ্রুতি, তারা ক্ষমতায় এলে দিল্লিতে বাড়ির ভাড়াটেরাও দুইশ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রিতে পাবেন। তারপর ৫০ শতাংশ ভর্তুকিরও সুযোগ পাবেন। তাদের জলের জন্য মাসুলও দিতে হবে না।
ছবি: jayantbahel/Pond5/IMAGO
বিজেপি নারীদের আড়াই হাজার টাকা দেবে
বিজেপি-র ইস্তাহারে বলা হয়েছে, তারা দিল্লিতে ক্ষমতায় এলে নারীদের আড়াই হাজার টাকা করে প্রতি মাসে দেবে। তাছাড়া গর্ভবতী নারীরা ২১ হাজার টাকা পাবেন। কম আয়ের নারীরা গ্যাস সিলিন্ডারে পাঁচশ টাকা ভর্তুকি পাবেন। মেয়েদের বিনা পয়সায় বাসে চড়ার সুবিধা চালু থাকবে।
বিজেপি-র প্রতিশ্রুতি, সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ভাতা বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হবে। ৭০ বছরের বেশি বয়সিরা পাবেন তিন হাজার টাকা।
ছবি: Amarjeet Kumar Singh/AA/picture alliance
গরিবদের জন্য
বিজেপি-র প্রতিশ্রুতি, তারা ক্ষমতায় এলে গরিব এলাকায় গরিবদের জন্য অটল ক্যান্টিন চালু হবে, যেখানে পাঁচ টাকায় পুষ্টিকর খাবার পাবেন গরিবরা।
ছবি: Aamir Ansari/DW
বিদ্যুতে ভর্তুকি থাকবে
বিজেপি জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় এলে দুইশ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দেয়ার যোজনা চালু থাকবে। তাছাড়া তারা আয়ুস্মান ভারত বিমা যোজনা দিল্লিতে চালু করবে। এছাড়াও দিল্লির মানুষদের জন্য একটি অতিরিক্ত বিমা চালু করা হবে।
ছবি: Adnan Abidi/REUTERS
কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি তিনশ ইউনিট বিদ্যুৎ
কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি, তারা ক্ষমতায় এলে দিল্লিবাসীকে তিনশ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দেবে। এছাড়া তারা মেয়েদের জন্য পেয়ারি দিদি যোজনা আনবে, যেখানে নারীরা প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে পাবেন। গরিবরা তাদের রেশনের পাশাপাশি গ্যাস সিলিন্ডারেও পাঁচশ টাকা ভর্তুকি পাবেন।
ছবি: Indian National Congress party
বেকারদের ভাতা
কংগ্রেস জানিয়েছে, বেকাররা যাতে স্থানীয় শিল্পসংস্থায় অ্যাপ্রেন্টিসশিপ করতে পারে, তার জন্য এক বছর তাদের সাড়ে আট হাজার টাকা দেয়া হবে।
ছবি: UNI
২৫ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা
কংগ্রেস বলেছে, ক্ষমতায় এলে তারা দিল্লির মানুষের জন্য তারা ২৫ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা করবে।
ছবি: Rauoof Ganie/DW
12 ছবি1 | 12
একই কাজ করেছে বিজেপি। শুধু দিল্লির নেতারাই নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নেতারা এসে প্রচার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী, রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ রাজ্যের নেতারা গিয়ে জনসভা করেছেন।
কংগ্রেসও বিভিন্ন রাজ্য থেকে কর্মী ও নেতাদের নিয়ে এসে প্রচার করেছে। দিল্লিতে প্রায় সব রাজ্যের মানুষ আছেন। তবে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সংখ্য়া প্রচুর। তাই এই সব রাজ্য থেকে নেতাদের নিয়ে এসেছে সব দলই।
এরপরেও যে প্রশ্নটা রয়েছে, কে এবার জিততে পারে? প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এবার তীব্র লড়াই হচ্ছে। বিজেপি দিল্লি দখল করতে এবং কেজরিওয়ালকে হারাতে ঝাঁপিয়েছে। গত কয়েকটি বিুধানসভা নির্বাচনে দেখা গেছে, বিজেপি ৩৫ শতাংশের মতো ভোট পায়। তারা অন্তত সেই ভোট ধরে রাখতে পারবে। প্রশ্ন হলো, কেজরিওয়ালের দলের ভোট কমবে কিনা, কমলে সেটা কোনদিকে যাবে?''
জয়ন্ত মনে করেন, ''এখানে দলিত ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। গত নির্বাচনে সেই ভোটের সিংহভাগ আপ পেয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস এবার দিল্লিতে তাদের এই পুরনো ভোটব্যাংক উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। কংগ্রেস মুসলিম ভোটেরও দাবিদার। তবে অনেক মুসলিমের মনে হচ্ছে, কেজরিওয়ালই বিজেপি হারাতে পারবেন। তাই তাদের ভোট আপ-এ যেতে পারে। আর দিল্লির মধ্যবিত্তদের কেজরিওয়ালের উপর মোহভঙ্গ হয়েছে।''
সলিল নন্দী মনে করছেন, গত দুইবারের তুলনায় বিজেপি এবার অনেক ভালো জায়গায় আছে। ভোটদাতারা কেজরিওয়ালকে নিয়ে আর আগের মতো উন্মাদনা দেখাচ্ছেন না।
কিন্তু অনুপ ঠাকুর নিশ্চিত যে, আসন কমলেও আপই সরকার গঠন করতে পারবে। দিল্লির গরিব মানুষ এখনো কেজরিওয়ালের সঙ্গে আছেন।