বুথ ফেরত সমীক্ষার হিসেব ছাড়িয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতায় দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে এলো অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমী পার্টি৷ দিল্লি বিধানসভার ইতিহাসে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসন নিজের ঝুলিতে ভরে এক নয়া রেকর্ড গড়লো তারা৷
বিজ্ঞাপন
মাত্র তিনটি আসন জুটেছে বিজেপির কপালে, অর্থাৎ থেমে গেছে মোদীর ঢেউ৷ অন্যদিকে কংগ্রেস তো কার্যত নিশ্চিহ্ন, একটি আসনও জোটেনি তাদের৷ এই অভাবিত সাফল্যকে হাতিয়ার করে সম্ভবত আগামী ১৪ কিংবা ১৫ই ফেব্রুয়ারি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিতে চলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷
২০১৩ সালে এই কেজরিওয়ালই ৪৯ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন দুর্নীতি-বিরোধী জনলোকপাল বিল বিধানসভায় পাশ করাতে না পারায়, যেহেতু সে সময় আম আদমি পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্টতা ছিল না৷ কংগ্রেসের হাত ধরে চলতে হয়েছিল৷ তা সত্ত্বেও অনেকেই বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি৷ মনে করেছিলেন আম জনতার সঙ্গে এটা বিশ্বাসঘাতকতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব৷ কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে ২০১৫ সালের নির্বাচনে আম আদমি পার্টি সংক্ষেপে আপ কিভাবে ফিরে পেল ভোটদাতাদের আস্থা৷
আপ-এর জয় আর বিজেপির ভরাডুবির মূল কারণ কি? মাত্র নয় মাস আগে যে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন, এত তাড়াতাড়ি সেই জনপ্রিয়তা মুখ থুবড়ে পড়লো কেন?
প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে প্রথম থেকেই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কিরণ বেদীকে তুলে ধরাকে দলের ভেতরে অনেকেই মনে মনে মেনে নিতে পারেননি, যা নিয়ে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ ছিল৷ তাঁদের মতে কিরণ বেদী বিজেপিতে আসেন মাত্র কিছুদিন আগে৷ এসেই তাঁকে একেবারে দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হলো, অথচ যাঁরা দলের হয়ে দীর্ঘদিন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তাঁদেরকে উপেক্ষা করা হলো, এটা অবিচার ছাড়া আর কী? দ্বিতীয়ত, অনেকে মনে করেন, মোদী জমানায় হিন্দুত্ববাদি সংগঠনগুলি যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে ঝুঁকেছে, সেটা দেখেও না দেখার ভান করে গেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ তৃতীয়ত, মোদীর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পালনের আহামরি ফল এখনো চোখে পড়ছে না৷
অন্যদিকে আম আদমি পার্টি জাতীয় রাজনৈতিক দল নয় ঠিকই, প্রকৃত অর্থে নিছক দিল্লি-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক দল৷ দিল্লির স্থানীয় সমস্যা বিশেষ করে নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষদের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল৷ তাই বিদ্যুৎ, পানি ও আবাসন ছিল দলের প্রধান নির্বাচনি ইস্যু৷ বিদ্যুতের দাম অর্ধেক করার এবং নিম্নবিত্তদের জন্য ২০ হাজার লিটার জল বিনা পয়সায় দেবার অঙ্গীকার বহাল আছে৷
ধর্মনিরপেক্ষতা বা গণতন্ত্রের মতো ঐ সব ভারি ভারি কথায় খেটে খাওয়া মানুষদের মন টানে না৷ সবথেকে বড় কথা, আম আদমি পার্টির তরুপের তাস দুর্নীতি দমন৷ এই প্রশ্নে অন্যদের তুলনায় কেজরিওয়াল অনেক বেশি সজাগ ও তাঁর অবস্থান অনেক বেশি কঠোর৷ এই প্রশ্নেই মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন কেজরিওয়ালে৷ আর দিল্লির মধ্যবিত্ত সমাজ মনে করে, আম আদমি পার্টি বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির বিকল্প না হলেও এক বিকল্প রাজনীতির সন্ধান দিতে পারে৷ ২০১৫ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারির ভোটে যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়েছেন কেজরীবাল, তাতে এবার দুর্নীতি বা অন্যান্য জনমুখী কর্মসূচি পালনে তাঁর অসুবিধা হবার কথা নয়৷ নিরহঙ্কারি মানুষ কেজরিওয়াল ভোটের ফলাফল দেখে নিজেই বলেছেন, এবার তাঁর বীজমন্ত্র হবে দিল্লির উন্নয়ন৷ তবে এখানেও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে৷ দিল্লি দেশের রাজধানী, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, দিল্লির উন্নয়নের অনেকটাই নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকুল্যের ওপর৷ কেন্দ্রের সাহায্য কতটা আদায় করতে পারবেন কেজরিওয়াল, সেটাও দেখার৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!