নাৎসি যুগের অধিকৃত ফ্রান্সের কিছু চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে৷ বোর্দো শহরে এমনই এক বিশাল স্থাপনাকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে দুঃস্বপ্নমুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে৷ শহরের মানুষ নতুন করে জায়গাটি আবিষ্কারের সুযোগ পাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
পানি, আলো এবং সিমেন্ট – ফ্রান্সের বোর্দো শহরে ‘বাস্যাঁ দ্য লুমিয়ে’ বা আলোর জলাধারে এই তিন উপাদানের চোখ ধাঁধানো মিশ্রণ দেখা যায়৷ উদ্বোধনের সময় চিত্রকর গুস্তাভ ক্লিম্ট ও পোল ক্লে সম্পর্কে আলোর শো দেখানো হলো৷ এই মাল্টিমিডিয়া শো-র দর্শকরা দুই শিল্পীর চিত্রকর্মে কার্যত ডুব দিতে পারলেন৷
বোর্দো শহরের অনেক বাসিন্দার মনে সিমেন্টের এই নির্মাণকাজ শুধু খারাপ স্মৃতি বয়ে আনে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বাহিনী এই বাংকার গড়ে তুলেছিল৷ ১৫টি বড় সাবমেরিন সেখানে নোঙর করা থাকতো৷ এখন সেই স্থাপনা সত্যি নতুন আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে৷ পানির উপর প্রতিফলনের কারণে ১২,০০০ বর্গ মিটার এলাকার উপর এই স্থাপত্য যেন রূপকথার জগতের হালকা দুর্গের মতো দেখাচ্ছে৷
এই রূপান্তর ঘটাতে এক কোটি ৪০ লাখ ইউরো ব্যয় হয়েছে৷ প্রদর্শনীর কর্ণধার আগুস্ত্যাঁ দ্য কোঁয়াতেৎ দ্য ফিল্যাঁ বলেন, ‘‘প্রথমবার এই স্থাপনা দেখে বিশাল আকারের কারণে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম৷ এখানকার অনবদ্য পরিবেশ একইসঙ্গে কিছুটা ভয় জাগানো, রহস্যময় এবং কাব্যময়৷ ফলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেখানে কিছু করার প্রেরণা পেয়েছিলাম৷ তবে এমন বিশাল এবং প্রায় বৈরি এক জায়গায় মনোমুদ্ধকর প্রদর্শনীর আয়োজন করা সত্যি এক চ্যালেঞ্জ ছিল৷’’
যুদ্ধের স্মৃতি ভোলাতে শৈল্পিক প্রদর্শনী
03:58
এই স্থাপনা গড়ে তুলতে ছয় লাখ ঘন মিটার সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল৷ পানির উপরিভাগই দশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে৷ এমন জায়গায় জটিল অডিও-ভিশুয়াল প্রযুক্তি বসানো মোটেই সহজ কাজ ছিল না৷ অডিও-ভিশুয়াল ডায়রেক্টর সাব্রি সোলতানি বলেন, একশোটিরও বেশি ভিডিও প্রোজেক্টর রয়েছে৷ প্রত্যেকটি লোকচক্ষুর অন্তরালে বসানো হয়েছে৷ সেটা ছিল ভীষণ জটিল কাজ৷ বিভিন্ন উচ্চতায় এই সব ভারি যন্ত্রপাতি পানির মধ্যে লাগাতে হয়েছে৷
যুদ্ধ ও ধ্বংসলীলার সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিকভাবে কুখ্যাত একটি স্থাপনা আলো ও সংগীতের খেলার মাধ্যমে নতুন মাত্রা পেয়েছে৷ শিল্পকলাই এই রূপান্তর ঘটিয়েছে৷ মাটিও মার্সঁ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডুবোজাহাজের এই বাংকার নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ তিনি সেই ইতিহাসের মূল্যায়ন করে বলেন, ‘‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ এই বাংকারের কথা ভুলে গিয়েছিল৷ সেটি যেন বন্দর ও শহরের জন্য বিষাক্ত এক উপহার হয়ে উঠেছিল, যা আর কোনো কাজে লাগার কথা ছিল না৷ শহরের বাসিন্দা ও এই স্থাপনার মধ্যে এক ধরনের আপোশের জন্য সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল৷ আজ বোর্দো শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সেটি পরিচিতি পাচ্ছে৷’’
২০২১ সালের শুরু পর্যন্ত বর্তমান প্রদর্শনী চলার কথা৷ তারপর সেখানে অন্যান্য শিল্পীদের সৃষ্টিকর্ম তুলে ধরা হবে৷
এই উৎসব অনুভূতির মাধ্যমে পূর্ণতা পাচ্ছে৷ শিল্প যে কুখ্যাত কোনো জায়গাকে নতুন মাত্রা দেবার ক্ষমতা রাখে, সেই উপলব্ধিও হচ্ছে৷
ইয়েন্স লার্খার/এসবি
স্পন্সরের ধার ধারেননি যে শিল্পী
বুলগেরিয়ান-অ্য়ামেরিকান শিল্পী ক্রিস্টো রোববার ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। বিশাল আকারের শিল্পকর্ম তৈরির জন্য পরিচিতি পাওয়া ক্রিস্টো কখনো অর্থের জন্য় স্পন্সরদের কাছে ধরনা দেননি।
ছবি: Reuters/S. Dawson
অসম্পূর্ণ কাজ
প্য়ারিসের অন্য়তম আকর্ষণ ‘আর্ক দে ট্রিয়ম্ফ’কে এভাবেই পুনরায় ব্য়বহারযোগ্য় কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন ক্রিস্টো। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য় এই শিল্পকর্মটি দর্শকদের জন্য় উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। জানা গেছে, ক্রিস্টো রোববার মারা গেলেও তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হবে। ক্রিস্টোর শিল্পকর্মের একটি বড় অংশ হচ্ছে বিখ্য়াত কোনো স্থাপনাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া।
ছবি: AFP/Christo and Jeanne-Claude - 2018 Christo/Andre Grossmann
ক্রিস্টো ও তাঁর স্ত্রী জেন ক্লোদে
১৯৩৫ সালের ১৩ জুন বুলগেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ক্রিস্টো। সোফিয়ায় পড়াশোনা শেষে তিনি পালিয়ে প্য়ারিস চলে যান। সেখানে জেন ক্লোদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বিয়ে করেন তাঁরা। ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে এই দম্পতি বিভিন্ন আর্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করেন। ক্রিস্টো শিল্পের দিকটি দেখতেন। আর আয়োজনের দায়িত্ৱে ছিলেন জেন ক্লোদে। ২০০৯ সালে জেন ক্লোদে মারা যান।
ছবি: picture alliance/KEYSTONE
বাতাস নিয়ে কাজ
সমসাময়িক শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ‘ডকুমেন্টা’ প্রতি পাঁচ বছর পরপর জার্মানির কাসেল শহরে অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীর চতুর্থ আসর বসেছিল ১৯৬৮ সালে। সেখানে ‘এয়ার প্য়াকেজ’ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ক্রিস্টো। কাপড়ে বাতাস ভরে তৈরি পাঁচ হাজার ছয়শ ঘনমিটারের এই শিল্পকর্ম ক্রিস্টোকে বিশ্ৱব্য়াপী পরিচিতি এনে দিয়েছিল।
ছবি: cc-by-3.0/Dr. Ronald Kunze
বিশাল পর্দা (১৯৭২)
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর রাইফেল গ্য়াপ উপত্য়কায় এই বিশাল পর্দাটি বসিয়েছিলেন ক্রিস্টো। নিজের আঁকা ছবি ও শিল্পকর্মের মডেল বিক্রি করে তিনি এমন সব বড় শিল্পকর্ম তৈরির টাকা জোগাড় করতেন। ফলে কোনো স্পন্সরের কাছে তাঁকে ধরনা দিতে হতো না। স্বাধীনভাবে কাজ করার আগ্রহ থেকে এই কৌশল বেছে নিয়েছিলেন ক্রিস্টো।
ছবি: picture alliance/Everett Collection
একই জিনিস অন্য়ভাবে দেখা (১৯৮৫)
ক্রিস্টো ও জেন ক্লোদে কখনো কোনো স্থাপনা এমনভাবে ঢাকতেন না যাতে বাইরে থেকে প্রকৃত স্থাপনাটাই বোঝা না যায়! ছবিতে ফ্রান্সের সিন নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে পুরনো সেতু ‘পো নফ’কে কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া বুঝে কাপড়ের রং একেক সময় একেকরকম হয়েছিল। ফলে একটা ‘পো নফ’কে বিভিন্ন রূপে দেখতে পেরেছিলেন দর্শকরা।
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ
নব্বইয়ের দশকে ‘দ্য় আমব্রেলাস’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে জাপান ও ক্য়ালিফোর্নিয়ায় প্রায় তিন হাজার ছাতা বসিয়েছিলেন ক্রিস্টো। এই কাজ করতে গিয়ে একজন কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরপর থেকে ক্রিস্টো শুধু পেশাদার শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো শুরু করেন। বিভিন্ন জার্মান কোম্পানিকে দিয়ে তিনি বিশাল আকারের কাপড় তৈরির কাজ করিয়েছেন।
ছবি: Getty Images/Gamma-Rapho/K. Kaku
ঢাকা ‘রাইশটাগ’
বিশাল আকারের একটি শিল্পকর্ম তৈরির পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত অনেক সময় লেগে যেতো। যেমন ১৯৯৫ সালে জার্মানির সংসদ রাইশটাগ ঢাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে সময় লেগেছে ২৩ বছর। ১৬ দিন ধরে প্রায় ৫০ লাখ দর্শক এই শিল্পকর্ম দেখেছেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/Kneffel
তেলের পিপা দিয়ে শিল্পকর্ম
১৯৬০-এর দশকে তেলের পিপা দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন ক্রিস্টো। বার্লিন প্রাচীর তৈরির প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে তেলের পিপা দিয়ে প্য়ারিসের একটি রাস্তায় অবরোধ তৈরি করেছিলেন। এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘আয়রন কার্টেন’। এরপর ১৯৯৯ সালে জার্মানির ওবারহাউসেনে গ্য়াস রাখার জন্য় তৈরি গ্য়াসোমিটারে প্রায় ১৩ হাজার তেলের পিপা দিয়ে ২৬ মিটার দীর্ঘ একটি প্রাচীর তৈরি করেছিলেন ক্রিস্টো। তার নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য় ওয়াল’।
ছবি: Wolfgang Volz
অন্য় কাজ
স্থাপনা ঢাকা ছাড়াও ল্য়ান্ডস্ক্য়াপ ও পার্ট ডিজাইনের কাজও করেছেন ক্রিস্টো ও জেন ক্লোদে। ২০০৫ সালে নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ‘দ্য় গেটস’ বানিয়েছিলেন তাঁরা।
ছবি: picture-alliance/Schroewig/Graylock
গ্য়াসোমিটারে আবার ফেরা
জার্মানির ওবারহাউসেনের গ্য়াসোমিটারে ‘দ্য় ওয়াল’-এর পর ক্রিস্টোর দ্বিতীয় শিল্পকর্মটি ছিল ২০১৩ সালে। স্ত্রীর মৃত্য়ুর চার বছর পর এটি তৈরি করেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে জার্মানির কাসেলে কাপড়ে বাতাস ভরে ‘এয়ার প্য়াকেজ’ তৈরি করে বিশ্ৱে পরিচিতি পাওয়া ক্রিস্টো ২০১৩ সালে এসে গ্য়াসোমিটারে আরেকটি ‘এয়ার প্য়াকেজ’ তৈরি করেছিলেন। সেবার অবশ্য় এর মধ্য়ে হাঁটাহাঁটি করতে পেরেছিলেন দর্শকরা। যেন মহাশূন্য়ে হাঁটার অনুভূতি!
ছবি: Wolfgang Volz
‘ফ্লোটিং পিয়ার্স’ (২০১৬)
পানির ওপর হাঁটার শখ ক্রিস্টোর অনেকদিনের। তাই ইটালির এক লেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ফ্লোটিং পিয়ার্স’ তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রায় ১২ লাখ দর্শক এই পন্টুনের উপর হেঁটেছেন। ১৩ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১২৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের টাকা ক্রিস্টো পেয়েছেন নিজের ছবি আর ড্রয়িং বিক্রি করে।
ছবি: Getty images/F.Monteforte
আবারও তেলের পিপা
২০১৮ সালে লন্ডনের হাইড পার্কে প্রায় সাড়ে সাত হাজার তেলের পিপা দিয়ে ‘দ্য় মাস্তাবা’ তৈরি করেছিলেন ক্রিস্টো। মাস্তাবা হচ্ছে পিরামিডের মতো মিশরেরই আরেক ধরনের গোরস্তান , যেখানে মানুষদের কবর দেয়া হতো।