ঢাকায় আবারো দুই শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশের মানুষ স্তম্ভিত৷ সোমবার এই দুই ভাই-বোন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন পরিবারের সদস্যদের হাতে, পারিবারিক কলহের জেরে৷ এ ঘটনায় তাদের মাকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷
ছবি: picture alliance / ZB
বিজ্ঞাপন
[No title]
This browser does not support the audio element.
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বাংদেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপরাধীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিষ্পাপ শিশুদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে৷ এছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা, সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, মানবপাচার, বিরোধ বা শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমাগত শিশু হত্যাকাণ্ডের কারণ৷'
মানবাধিকার এই সংস্থা আরো মনে করে, ‘শিশুহত্যার মতো ঘৃণিত অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় শিশু হত্যার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে৷' তাদের হিসাব মতে, গত এক বছরে ২৯২টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ আর গত চার বছরে সারাদেশে এক হাজার ৮৫টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়এছে সংস্থাটি৷
শিশু হত্যার এই ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গে আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো যে, মূলত পরিবারের সদস্য, আত্মীয় এবং পরিচিতদের হাতেই অধিকাংশ শিশু হত্যা বা নৃশংসতার শিকার হচ্ছে৷
‘শিশু কাঁদলে, তাকে কোলে তুলে নিন’
বাচ্চা কাঁদলে কোলে তুলে নেয়াটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে উপ-মহাদেশের বাবা-মা এবং পরিবারের মানুষদের কাছে৷ এ নিয়ে তাঁদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই৷ কিন্তু জার্মানিতে? চলুন বিস্তারিত জানা যাক এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
শিশুরা কাঁদে কেন?
যে কোনো শিশুই চিৎকার করে কেঁদে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর জানিয়ে দেয়৷ তারপরও কারণে-অকারণেই ওরা কাঁদে৷ এই সুন্দর ভুবনের সাথে মানিয়ে নিতে ওদের যেমন কিছুটা সময় লাগে, তেমনই নতুন মা-বাবারও লাগে খানিকটা সময় সব কিছু গুছিয়ে নিতে৷ যা খুবই স্বাভাবিক৷
ছবি: Fotolia/S.Kobold
আমার কান্না কেউ কি শুনছে না?
মাঝে মাঝে শিশুরা চিৎকার করে ওঠে, বিশেষ করে কাছাকাছি অনেকক্ষণ কোনো শব্দ শুনতে না পেলে৷ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই হয়ত তখন কাঁদে তারা৷ মজার ব্যাপার, ঐ মুহূর্তে কেউ কাছে গিয়ে কথা বললে বা কোলে তুলে নিলে সাথে সাথেই শিশুদের কান্না থেমে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাঙালি বাবা-মায়ের সন্তান
দেশে সন্তান জন্মের পর থেকেই সে বাচ্চা কোলে কোলে থাকে৷ বাচ্চা কাঁদুক আর না কাঁদুক৷ নতুন মা সারাক্ষণই তাঁর শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত আর সেই শিশু সর্বক্ষণই পেয়ে থাকে মায়ের শরীরের উষ্ণতা৷ শিশুকে কোলে নেওয়ার জন্য বাবা-মা ছাড়াও আত্মীয়স্বজন থাকেন৷ এছাড়া, বাচ্চাকে শুধু দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোকও অনেক সময় রাখা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Joker
জার্মান শিশু
জার্মানিতে কোনো শিশু কাঁদলেই চট করে কোলো তুলে নেওয়া হতো না কয়েক বছর আগ পর্যন্তও৷ শিশু কাঁদলে ওকে শুইয়ে রাখা হতো৷ এক সময় সেই ছোট্ট শিশু কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরতো৷ কারণ, মা সারাক্ষণ বাচ্চাকে কোলো নিলে বাড়ির অন্য কাজ কে করবে? রাতে প্রতিদিন ঘড়ি ধরে একই সময়ে বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হতো ঘর অন্ধকার করে৷ বলা বাহুল্য জার্মানিতে গ্রীষ্মকালে প্রায় ১১টা পর্যন্ত বাইরে সূর্যের আলো থাকে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Timothy Clary
সময় পাল্টেছে, বদলেছে চিন্তাধারা
একদিকে যেমন জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলিতে প্রযুক্তি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশেরও কিছু বিষয় গ্রহণ করতে শুরু করেছে তারা৷ শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গেন কামেদা বলেন, পশ্চিমের সংস্কৃতিটা এমন যে শিশুরা মায়ের শরীরের উষ্ণতা কম পায়, কারণ এ দেশে বাচ্চারা বিছানায় বেশি সময় থাকে আর এটাই হয়ত শিশুদের রাতে কান্নাকটি করার বড় কারণ৷
ছবি: Yuri Arcurs/Fotolia
নতুন বাবা-মা
নতুন মা-বাবার নানা প্রশ্ন, শিশুটির কান্নার কারণ তাঁরা বুঝতে পারেন না৷ ক্ষুধা, শরীর খারাপ, ক্লান্ত নাকি আদর, কি চায় বেবিটি? আসলে শরীরের উষ্ণতা পেলে শিশুরা সব কিছুই ভুলে যায়, যদি না বড় কোনো শারীরিক কষ্ট থেকে থাকে, বলেন ডা. কামেদা৷ তাঁর পরামর্শ, পিতা-মাতা হলে অনেককিছুই বাদ দিতে হয়, তাই বাইরে গেলে শিশুকে কোলে করে সঙ্গে নেবার চেষ্টা করবেন – যাতে শিশুটি শরীরের উষ্ণতা পায়৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ডাক্তারের পরামর্শ
নতুন বাবা-মায়ের জন্য ডাক্তার কামেদার আরো পরামর্শ, শিশুর কাছাকাছি থাকুন, শিশুকে সময় দিন, কোলে তুলে নিন৷ অল্প কিছুদিন পরেই দেখবেন, শিশু শুধু কাঁদেই না, বরং খুব শীঘ্রই তারা হাসতে শিখবে, হাসাবে মা-বাবাকেও৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
7 ছবি1 | 7
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোটে এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত একবছরে শিশু হত্যা ও শিশুর প্রতি সহিংসতা যেভাবে বেড়েছে তাতে আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷'' তাঁর কথায়, ‘‘এখন ঘরেই শিশুরা নিরাপদ নয়৷ বাবা-মায়ের হাতেই শিশুদের জীবন দিতে হচ্ছে৷ মূল্যবোধের এরচেয়ে আর চরম অবক্ষয় কী হতে পারে!''
তিনি আরো বলেন, ‘‘শিশুরা অসহায়৷ তারা প্রতিবাদ করতে পারে না৷ তারা এখন লোভ- লালসা এবং প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হচ্ছে৷ তারা কোনো স্বার্থের সঙ্গে জড়ির না থাকলে স্বার্থেরই বলি হচ্ছে তারা৷''
এলিনা খান বলেন, ‘‘দেশে শিশু নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন আছে৷ কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এই আইনে কাজ হবে না৷ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা শিশুদের গুরুত্ব দেয় না৷ শিশুদের প্রতি যে অপরাধ করা হয়, তা সহজে আমলে নিতে চায় না তারা৷ তাই শিশুদের বিষয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দেয়া হলে আমরা ভয়াবহ বির্যয়ের মুখে পড়ব৷''
তাঁর মতে, ‘‘পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শিশুরা কোথায় নিরাপত্তা পাবে তাই বোঝা মুশকিল৷ তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে৷ শিশুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে৷''
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রত্যেক এলাকার থানাগুলোতে শিশুদের জন্য ‘হেল্প ডেস্ক' থাকার বিধান আছে৷ কিন্তু বাস্তবে আইনে থাকলেও তা কাজে নেই৷ যেমন এলিনা খানের কথায়, ‘‘কাগজে কলমে আছে, কিন্তু তা কার্যকর নেই৷'' তাই ‘‘এখন থেকেই জরুরি ভিত্তিতে শিশু-বান্ধব পরিবেশ তৈরির কাজ শুরু করা দরকার৷ নয়ত পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে৷''
শিশুদের নিয়ে মন খারাপ করা কিছু খবর
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়৷ শিশুদের নিয়ে ছবিঘরে থাকছে এমন কিছু তথ্য, যা পড়ে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাত মাসে ৬১ গণধর্ষণ
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৬১টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় ফোরামটি৷ একই সময়ে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয় ৩৪৭টি শিশু৷ এর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিয়ে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷ আর ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয় বয়স ১৮ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস খোদ ঢাকা শহরে৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কিশোর অপরাধী
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হয়৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷
ছবি: bilderbox
মাত্র তিনটি
আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার করা হয় কিশোর আদালতে৷ এরপর বিচার শেষে শাস্তি ভোগের জন্য তাদের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র তিনটি৷ গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০৷ অর্থাৎ আটক শিশুদের বড় একটি অংশের জায়গা উন্নয়ন কেন্দ্রে হয় না৷ ফলে তাদের কারাগারে থাকতে হয়৷