দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পরামর্শ
১১ মার্চ ২০২২
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ টকশোতে অংশ নেয়া দুই আলোচক আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন৷ তারা মনে করছেন, সরকার চাইলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷
বিজ্ঞাপন
গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নূর অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন৷ কিন্তু জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী মনে করছেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত দাম নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘সরকার দ্রুত ঠিক করতে পারে যে, আমরা জনগণকে ১০০ টাকায় সয়াবিন তেল দিব৷ সেক্ষেত্রে আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ তাদের যদি ১২০ টাকা খরচ হয় তাহলে তাদের পাঁচ টাকা লাভ দিয়ে ১২৫ টাকায় সরকার তেল কিনে নিবে৷ তারপর সরকার এটা ন্যায্যমূল্যের চেয়ে কম দাম বিক্রি করবে৷''
কিন্তু এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো ব্যবস্থাপনা এই মুহূর্তে সরকারের আছে কিনা এবং সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা জানতে চাইলে পাটোয়ারী বলেন, ‘‘অবশ্যই সম্ভব৷''
দাম নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘অসাধু ব্যবসায়ী থাকলে তাকে তো চিহ্নিত করতেই হবে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সরকার আর ব্যবসায়ী এক হয়ে গেছে৷ আমরা বিএনপির আমলেও দেখেছিলাম পেঁয়াজের সিন্ডিকেট নিয়েছিল এক ব্যক্তি, মরিচের সিন্ডিকেট নিয়েছিল এক ব্যক্তি, রসুনের সিন্ডিকেট নিয়েছিল আরেক ব্যক্তি৷ সরকার অবশ্যই সিন্ডিকেটকে ভাঙতে চাইবে, এটা আমরা আশা করবো৷ কিন্তু এটা সময়ের বিষয়৷ মার্কেটে দাম বেড়ে গেলে সেই দাম কমতে সময় লাগবে, ততদিন অসংখ্য মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগবে, তাদের জমানো টাকা চলে যাবে এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়বে৷''
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলে সরকার অনেক অজনপ্রিয় হবে, এটা জানার পরও সরকার কেন উদ্যোগ নিচ্ছে না জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির সাংসদ পাটোয়ারী বলেন, ‘‘একটা বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরকারের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে৷ সরকার তাদের স্বার্থ দেখে, তারা সরকারের স্বার্থ দেখে৷ ফলে জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়৷ সহজ উপায়ে অধিক অর্থ আয়ের জন্য সরকার বাধ্য হচ্ছে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ এজন্যই আমি বলছি, সরকার কিনে প্রয়োজনে কম দামে বিক্রি করবে৷ টাকা খরচ হবে সরকারের হবে, জনগণের না৷''
বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মুদি বাজার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদি বাজারের মধ্যে তুলনা করা কঠিন৷ মার্কিন এক কোম্পানি সীমিত আকারে সেই চেষ্টা করেছে৷ তাদের দেয়া তথ্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: David McNew/Getty Images
গ্রোসারি সূচক ২০২১
ব্যক্তিগত লোন দেয়ার মার্কিন অনলাইন কোম্পানি ‘নেটক্রেডিট’ গতবছর ৯ নভেম্বর ২০২১ সালের গ্রোসারি সূচক প্রকাশ করে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপারমার্কেটের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়৷ প্রথমে, বাজারের একটি তালিকা তৈরি করে সেগুলোর দাম কোন দেশে কেমন, তা জানার চেষ্টা করা হয়৷ সূচকটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: David McNew/Getty Images
১০টি পণ্যের তথ্য
সূচক তৈরিতে যে ১০টি পণ্যের তথ্য নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো সকালের নাস্তার জন্য সিরিয়াল, ১২টি ডিম, ৫০০ গ্রাম হাড় ছাড়া মুরগীর বুকের মাংস, ৫০০ গ্রাম মাখন, ১ লিটার বোতলজাত ভেজিটেবল তেল, ৫০০ গ্রাম সাদা পাউরুটি, ১ লিটার দুধ, ১ কেজি আলু, ১ কেজি টমেটো, ১ কেজি কলা, ১৪০ গ্রাম ক্যানড টুনা ও বোতলজাত দেড় লিটার পানি৷
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
বাংলাদেশে খরচ
উপরের পণ্যগুলো কিনতে বাংলাদেশে ১৯৯০ টাকা খরচ হতো বলে জানিয়েছে নেটক্রেডিট৷ বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে নেটক্রেডিট দেখেছে, এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের দৈনিক গড় বেতনের ৩৪০ শতাংশ৷
ছবি: DW
সবচেয়ে বেশি সুইজারল্যান্ডে, কম জিবুতিতে
এই ১০টি পণ্য কিনতে সুইজারল্যান্ডে খরচ পড়তো প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা৷ আর জিবুতিতে মাত্র ৬০০ টাকা৷
ছবি: ZDF
বাংলাদেশ চার নম্বরে
পণ্য কেনার খরচ বের করার পর নেটক্রেডিট বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে প্রতিটি দেশের মানুষের গড় দৈনিক আয় জানার চেষ্টা করেছে৷ এরপর এই দুই তথ্য দিয়ে ‘অ্যাফোরডিবিলিটি পার্সেন্টেজ’ বা সক্ষমতার হার বের করেছে৷ এতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সক্ষমতার হার ৩৪০ শতাংশ৷ অর্থাৎ ঐ ১০ পণ্য কিনতে খরচ হওয়া ১৯৯০ টাকা একজনের দৈনিক গড় বেতনের ৩৪০ শতাংশ৷ তালিকায় বাংলাদেশের উপরে আছে কম্বোডিয়া, কেনিয়া ও নিকারাগুয়া৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবচেয়ে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে ঐ ১০ পণ্য কিনতে খরচ পড়তো ২,২১২ টাকা, যা দেশটির দৈনিক গড় বেতনের মাত্র ১২ শতাংশ৷ এরপর আছে নেদারল্যান্ডস (খরচ ২১১৫ টাকা, সক্ষমতা ১৫ শতাংশ), লুক্সেমবার্গ (খরচ ২৯৩০ টাকা, সক্ষমতা ১৫ শতাংশ), ফিনল্যান্ড (খরচ ২১৪৬ টাকা, সক্ষমতা ১৬ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (খরচ ২৯৩৩ টাকা, সক্ষমতা ১৮ শতাংশ) ও যুক্তরাজ্য (খরচ ২২২২ টাকা, সক্ষমতা ১৯ শতাংশ)৷
ছবি: Photoshot/picture alliance
তথ্য নেই
গ্রোসারি সূচকে ভারত, পাকিস্তান, জার্মানিসহ অনেক দেশের তথ্য দেয়া হয়নি৷
ছবি: Martin Wagner/imago images
চালের দাম
৯ মার্চ, ২০২২ সালে সার্বিয়ার ক্রাউড-সোর্সড ভিত্তিক বৈশ্বিক ডাটাবেজ কোম্পানি ‘নাম্বেও’র ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায় বাংলাদেশে এক কেজি চালের (সাদা) দাম ৬০ টাকা৷ জাপানে দাম সবচেয়ে বেশি ৩৬৯ টাকা৷ এছাড়া যু্ক্তরাষ্ট্রে ৩৪০, সুইজারল্যান্ডে ২৫১, জার্মানিতে ১৮১, যুক্তরাজ্যে ১২৫, পাকিস্তানে ৭৬, ভারতে ৫৯, নেপালে ৬০ ও শ্রীলঙ্কায় ৫১ টাকা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পেঁয়াজের দাম
১০ মার্চ নাম্বেওর ওয়েবসাইটে দেখা যায় বাংলাদেশে এক কেজি পেঁয়াজের দাম সাড়ে ৫৩ টাকা৷ ভারতে ৪০ টাকা, পাকিস্তানে ২৫ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৬৬ টাকা, নেপালে ৪৯ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২২০ টাকা, যুক্তরাজ্যে ১০৮ টাকা ও জার্মানিতে ১২১ টাকা৷
ছবি: Reuters/L. Niesner
নাম্বেওর গ্রোসারি সূচক
নিউইয়র্ক শহরের বাজারের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারমূল্যের তুলনা করে তালিকা প্রকাশ করে নাম্বেও৷ এতে দেখা যাচ্ছে, নিউইয়র্কে যে গ্রোসারির দাম ১০০ টাকা৷ বাংলাদেশে সেটা ৩০ টাকায় পাওয়া যায়৷ জার্মানিতে পাওয়া যায় ৫২ টাকায়, যুক্তরাজ্যে ৫৬ টাকা, ভারতে ২৬ টাকা, পাকিস্তানে ১৭ টাকা ও নেপালে ২৬ টাকায়৷ সূচকটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: imago/Levine-Roberts
নাম্বেওর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য?
বিশ্বের যে কেউ নাম্বেওর ডাটাবেজে তথ্য ঢোকাতে পারে৷ তাই কেউ চাইলে ইচ্ছেমতো তথ্য দিতে পারে৷ সে কারণে নাম্বেওর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ এরপরও নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইকোনমিস্ট, টাইম ম্যাগাজিনের মতো বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় নাম্বেওর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ নাম্বেও বলছে, গত ১২ মাসে ঢাকার বিভিন্ন জিনিসের দাম নিয়ে মোট ৩,১৩২ বার তথ্য যুক্ত করেছেন ২৭৪ জন নাম্বেও ব্যবহারকারী৷
ছবি: Frank Hoermann/SvenSimon/picture alliance
11 ছবি1 | 11
নুরুল হক নূর বলেন, ‘‘নিজের ভালো পাগলেও বোঝে৷ কিন্তু সরকারতো এই পর্যন্ত নিজের ভালোটা বোঝে নাই৷ তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অজনপ্রিয়৷''
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোট ২৮ মার্চ আধা বেলা হরতালের ডাক দিয়েছে৷ তবে নুরুল হক নূর বলেছেন, এখনই তারা হরতাল করার মতো পরিস্থিতিতে যাবেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে নামতে আমরা রাজী৷ কিন্তু সেই ধরনের চূড়ান্ত পরিস্থিতি তৈরি হলে৷ আমরা এখনই রাস্তায় নেমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না৷ ইতিমধ্যে আমরা মামলা, হামলায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি৷''
সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীও হরতাল সমর্থন করেন না বলে জানিয়েছেন৷
শুক্রবার টকশো শুরুর আগে ইউটিউবে দর্শকদের মধ্যে একটি জরিপের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য কি ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী মনে করেন? প্রায় ৩৮ হাজার ভোট পড়েছে৷ এর মধ্যে মাত্র ছয় ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা মনে করেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ দায়ী৷