এই দুই সাহসী মেয়ের একজনের নাম তেজস্বিতা প্রধান এবং অন্যজন শিবানী গোন্ড৷ তেজস্বিতার বয়স ১৮ আর শিবানীর ১৭ বছর৷ এই বয়সেই তাঁরা জেনে গেছেন, নারী আর শিশুদের জন্য এ সমাজে পদে পদে বিপদ৷ তাঁরা জানেন, প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে প্রতি আট মিনিটে একজন শিশু নিখোঁজ হয়৷ নিখোঁজদের অনেকেই পড়ে পাচারকারীদের খপ্পরে৷
তেজস্বীতা আর শিবানীর বাড়ি দার্জিলিংয়ে৷ দার্জিলিংয়ের স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে অনেকেই সেখানে বেড়াতে যান৷ সীমান্তবর্তী অঞ্চলটিতে নারী ও শিশু পাচারকারীদেরও খুব উতপাত৷ ‘ম্যানকাইন্ড ইন অ্যাকশন ফর রুরাল গ্রোথ', সংক্ষেপে এমএআরজি, অর্থাৎ ‘মার্গ' নামের একটি এনজিওর তত্ত্বাবধানে কাজ করতে গিয়ে তেজস্বীতা আর শিবানীও এই বিষয়টি জেনেছেন৷
জেনে, সচেতন হয়ে বসে থাকেননি৷ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে স্ট্যাটাস লিখে জানিয়েছেন, তাঁরা কাজ করতে চান, কাজের সুযোগ থাকলে যে কেউ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন৷ পাচারকারীরা তো কাজ, টাকা আর বিলাসী জীবনের প্রলোভন দেখিয়েই নারী-শিশুদের ধরে নিয়ে যায়৷ তাই তাদের ফাঁদে ফেলতে ফেসবুকে এভাবে অনেকটা ‘কাজ চাই' বিজ্ঞাপনই দেন দার্জিলিংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুই সাহসী, অধিকার সচেতন মেয়ে৷
কলকাতার, তথা ভারতের অন্যতম বড় এবং প্রাচীন যৌনপল্লি হলো সোনাগাছি৷ জনশ্রুতি, জনৈক সোনা গাজির দরগা ছিল এই অঞ্চলে, তার থেকেই নাম সোনাগাছি৷ বহু মেয়ে এই যৌনপল্লিতে বিশ্বের আদিমতম পেশায় জড়িত৷
ছবি: DW/T. Meyerপুরনো কলকাতার বাড়ি যেমন হয়, একটি উঠোনকে ঘিরে অনেক ঘর, সোনাগাছির অধিকাংশ পুরনো বাড়িই ঠিক সেই নকশার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayদিনেরবেলা যৌনপল্লির কোনো ঘরে গেলে বোঝার উপায় নেই, যে এটা কোনো সাধারণ গৃহস্থ বাড়ি নয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayখোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে স্নান করেন মেয়েরা, যা কোনো গৃহস্থ বাড়িতে দেখা যায় না৷ কিন্তু উপায় নেই৷ সব ঘরের জন্য আলাদা স্নানের জায়গা এখানে বিলাসিতা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayকিন্তু রোজ সকালে আর পাঁচটা বাড়ির মতো এখানেও রান্না চাপে৷ সব কিছু তো আসলে পেট ভরাবার দায়েই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayআগের থেকে অনেক সাবধান হয়েছেন যৌনকর্মীরা, তবু কখনও অসাবধানে যৌনরোগের সংক্রমণ ঘটে৷ তবে তার চিকিৎসার জন্য এখন ডাক্তার পাওয়া যায় হাতের কাছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayযৌনকর্মীর সন্তান কেন যৌনকর্মীই হবে? অনেক মা তাঁর সন্তানদের পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা শিখতে৷ এভাবে অনেকেই নতুন জীবনের খোঁজ পান৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayবাচ্চাদের প্রাথমিক পড়াশোনার ভার যৌনকর্মীরা নিজেরাই নেন৷ তারপর উৎসাহীদের পাঠানো হয় প্রথাগত স্কুলে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayসোনাগাছির ভবিষ্যৎও এই শিশুরাই৷ যারা স্বপ্ন দেখে বেশ্যাপল্লির বাইরে গিয়ে এক নতুন জীবন খুঁজে নেওয়ার৷ অন্যদেরও দিশা দেখানোর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay তারপর মাত্র মাসখানেকের অপেক্ষা৷ তারপরই এক নারী ফেসবুকবন্ধু হতে চান৷ বন্ধু হওয়ার পর তিনি জানান, কাজ আছে, তবে কাজ পেতে হলে তার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে৷ তেজস্বিতা আর তো এমনটিই চেয়েছিলেন, সুতরাং রাজি হয়ে গেলেন!
নারী হয়ে অচেনা মানুষের সঙ্গে অচেনা জায়গায় যাওয়ায় অনেক ধরনের বিপদের আশঙ্কা থাকে৷ তেজস্বিতা এবং শিবানী তা ভালো করেই জানেন৷ আসলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পাচারকারীদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা শুরুর আগেই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিলেন৷ বেসরকারি সংস্থা ‘মার্গ'-কেও জানানো হয়েছিল বিষয়টি৷ ফলে নির্ধারিত দিনে ওই নারীর কথামতো ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছের একটি হোটেলে যাওয়ার সময় মনে ভয় থাকলেও একটু ভরসাও ছিল৷
সেখানে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেসবুকবন্ধু ঐ নারী চলে আসে৷ একটু পরে হাজির হয় এক দল কম বয়সি ছেলে৷ দেখে কে বলবে যে ওরাও পাচারকারী! একটা সময় যখন এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল, তখনই তেজস্বীতা আর শিবানী মাথা চুলকালেন৷ ওটা ছিল ইঙ্গিত৷ ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হোটেলের কয়েকজন কর্মচারী এসে ওই নারী আর ছেলেদের ধরে ফেললেন৷ ছেলেগুলো চ্যাঁচামেচি শুরু করতেই হোটেল কর্মচারীরা জানালেন, তাঁরা পুলিশ আর সুতরাং মেয়েদের ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷
এভাবে ঝুঁকি নিয়ে মানব পাচারকারীদের ধরিয়ে দেয়ায় তেজস্বিতা আর শিবানী সম্প্রতি গীতা চোপড়া অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন৷ প্রতি বছর প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের একটি দেশের সবচেয়ে সাহসী মানুষদের মাঝ থেকে একজন বা দু'জনকে বেছে নিয়ে তাঁদেরই দেয়া হয় এই জাতীয় পুরস্কার৷ তেজস্বিতা এবং শিবানী পেয়েছেন সেই পুরস্কার৷ তাঁদের তো এ মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে সাহসী মানুষ বলা যেতেই পারে!
মুরালি কৃষ্ণন/এসিবি
বছরের পর বছর ভারতে হাজারো শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর শোনা যায়, যাদের অনেকেরই আর কোনো খোঁজই পাওয়া যায় না৷ এদের কেউ নিজেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার কাউকে অপহরণ করে নানা রকম কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: DW/B. Dasভারতে ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে যে, ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ১১ জন শিশু নিখোঁজ হয়ে থাকে৷ এদের মধ্যে কমপক্ষে চারজনকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না৷
ছবি: DW/B. Dasদিল্লির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ১৬ বছর বয়সি মেয়ে পিংকিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অপরিচিত একটি বাড়িতে৷ সেখানে ওকে জোর করে ঘরের কাজ করানো হচ্ছে এবং বলা বাহুল্য, কোনো বেতন ছাড়াই৷
ছবি: DW/B. Dasছবিটিতে এক বাবার হাতে তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলের ছবি আর তাঁর অন্য হাতে একটি বাক্স৷ সে বাক্সে রয়েছে মানুষের সাহায্য করা অর্থ, যে অর্থ দিয়ে এই বাবা তাঁর ছেলেকে খুঁজে বের করতে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবেন বলে ঠিক করেছেন৷
ছবি: DW/B. Dasযেসব শিশুরা বাড়ি থেকে নিজের ইচ্ছায় চলে যায় বা পালিয়ে যায়, ওরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে কাজের ছেলে-মেয়ে হিসেবে বা এ ধরণেরই কোনো কাজ করে থাকে৷ যেমন চায়ের দোকান, পেট্রোল পাম্প বা কার্পেট তৈরি কারখানায়৷ ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির একটি পেট্রোল পাম্প থেকে এমনই কিছু শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
ছবি: DW/B. Dasছেলেটির হাতে ছয় বছর আগে ওর হারিয়ে যাওয়া বোনদের ছবি৷ ওদের খুঁজে পাবে এই আশায় এখনো বুক বেধে আছে ছেলেটির পুরো পরিবার৷ নিখোঁজ বোনদের ফিরে পাওয়ার জন্য পরিবার থেকে মাঝে মাঝেই বোনদের ছবি এবং নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিসহ প্রচারপত্র বিলি করা হয়৷
ছবি: DW/B. Dasনিখোঁজ হয়ে যাওয়া এই শিশুটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে৷ শিশুটি ওর বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ঠিক এ জায়গাতেই অপেক্ষা করছে গত প্রায় এক বছর যাবত৷ কবে শেষ হবে এই অপেক্ষার পালা?
ছবি: DW/B. Dasনিখোঁজ হয়ে যাওয়া অর্জুন আবারো মায়ের কোলে ফিরে এসে অত্যন্ত আনন্দিত, ভীষণ খুশি৷ অর্জুন ওর মাকে তার কষ্টের কথা জানিয়েছে৷ বলেছে, গত দু’বছর ওকে বেধে রাখা হয়েছিল এবং কাজ করতে বাধ্যও করা হয়েছিল৷ তবে ওর মা কিন্তু অর্জুনকে ফিরে পাবার আশা কখনো ছেড়ে দেয়নি৷
ছবি: DW/B. Dasএই মা তাঁর কয়েকজন শিশুর মধ্যে একজনকে হারিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আর কখনো আমি আমার শিশুদের চোখের আড়াল হতে দেব না৷ উল্লেখ্য, ‘শিশু বাঁচাও আন্দোলন’ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে www.bba.org.in ঠিকানায়৷
ছবি: DW/B. Das