দুদকের পাস মার্ক পেতে এত দেরি!
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২দুদক আইন ২০০৪-এর ৭ ধারা অনুযায়ী, কমিশনারদের মেয়াদকালের নিশ্চয়তা বিধান করে বলা হয়েছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যাতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাইবে না৷’’
আইন অনুযায়ী, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার যথাক্রমে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের সমান মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন৷
একজন চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনারের বাইরে দুদকের রয়েছে একাধিক মহাপরিচালক, পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ অসংখ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী৷ কিছু পদ শূন্য আছে বটে, তবে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেই৷
দুদকের কোন কোন কাজ করার কথা? আইন অনুযায়ী, দুদকের কাজের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত, মামলা দায়ের ও পরিচালনা, দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ে গবেষণা পরিকল্পনা তৈরি করা এবং ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ, সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা, গণসচেতনতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা৷ এর বাইরে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত অন্য যে কোনো কাজ সম্পাদন করা৷
দুদকের আগে দুর্নীতি প্রতিরোধে যে প্রতিষ্ঠানটি ছিল, তার নাম দুর্নীতি দমন ব্যুরো৷ ব্যুরো বিলুপ্ত করে ২০০৪ সালের আইনের মধ্য দিয়ে ওই বছর দুদক প্রতিষ্ঠিত হয়৷
দুই দশকের কাছাকাছি সময় পার করলেও দুদকের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে৷ এখন বোধ করি, একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে৷ কারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় ব্যয় হচ্ছে৷ সেই অর্থ দেশের সঠিক প্রয়োজনে ব্যয় হবে, এতটুকু প্রত্যাশা নাগরিকেরা করতেই পারে৷
স্বয়ং এই প্রতিষ্ঠানেরই একজন চেয়ারম্যান যখন বলেন, দুদক নখদন্তহীন বাঘ, তখন সত্যিই নড়েচড়ে বসতে হয়৷ আমরা ওই চেয়ারম্যানের কথা ভুলে যাইনি৷ ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর দুদকে যোগদানের পর এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছিলেন, ‘দুদক এখন একটি দন্তহীন বাঘ৷ এর সঙ্গে বাঘের সব নখ কেটে দেওয়ার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়া চলছে৷’ চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৩ সালের ২০ জুন বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে একই বাক্য আবার ব্যবহার করেন তিনি৷ অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে দুনীতি দমনে কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারার ব্যর্থতা তিনি স্বীকার করে নেন৷ দুদকের আইন সংশোধন করতে না পারা ছিল তাঁর প্রধান খেদ৷ তবে কাজ না করার জন্য কখনো কখনো আইনের ছুতো দেওয়া আমাদের একটা জাতীয় অভ্যাস৷
গোলাম রহমান চলে যাওয়ার পর পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে৷ ইত্যবসরে, দুদক আইনের কিছু সংশোধনীও হয়েছে৷ এর মধ্য দিয়ে দুদকের ক্ষমতার আওতা আরও বেড়েছে৷ সেগুলো কি কি? এক সময় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের মামলা করতে হতো পুলিশি থানায়৷ গত এক বছর ধরে তারা তাদের দপ্তরে মামলা করার সুবিধা ভোগ করছেন৷ এ ছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় অভিযোগ অনুসন্ধান না করেই সরাসরি মামলা করতে পারে দুদক৷ এর বাইরে দুদক এখন তদন্ত বা অনুসন্ধানের জন্য আয়কর বিভাগ এবং ব্যাংকগুলো থেকে ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে৷ দুদকের কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের গতিবিধি অনুসরণে তথ্যপ্রযুক্তি ও কল রেকর্ডের জন্য নিজস্ব সার্ভার স্থাপন করেছে দুদক৷
২.
কিন্তু কোনো কিছুই যেন দুদকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারছে না৷ সম্প্রতি কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দীনের চাকরিচ্যুতি দুদকের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সদিচ্ছা নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷ শরীফ উদ্দিন কক্সবাজারে সরকারের তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের দুনীতির চিত্র অনুসন্ধান করে দুদকের চট্টগ্রামের দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করেন, ২০২১ সালের জুন মাসে৷ ওই প্রতিবেদনে কক্সবাজার জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানসহ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ ১৫৫ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উল্লেখ করেন৷ সরকারের একজন সচিবও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ কিন্তু দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিবেদনগুলো নিয়ে পরবর্তী প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তা দিনের পর দিন ফেলে রাখেন৷ দুনীতির অনুসন্ধান করে শরীফ নাকি দুদককে বিব্রত করেছেন৷ শাস্তিস্বরূপ শরীফকে প্রথমে পটুয়াখালীতে বদলি, পরে চাকরিচ্যুত করা হয়৷ প্রভাবশালী মহলের জীবননাশের হুমকি মাথায় নিয়ে শরীফ এখন ঝুঁকির জীবনযাপন করছেন৷
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক তাঁর একজন সৎ, চৌকস অফিসারের পাশে না দাঁড়ালেও ইতিবাচক দিক হলো, শরীফের চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদ করেন তাঁর সহকর্মীরাই৷ তারা মানববন্ধন রচনা করে বিরল এক উদাহরণ তৈরি করেন৷ শরীফের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, এই মানববন্ধনের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বলা যায়৷ শরীফকে চাকরিচ্যুত করা হয় দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪ (২) বিধি অনুসারে৷ এই বিধি সংস্কারের দাবি অবশ্য সমর্থন করা যায়৷ কারণ দোষী ব্যক্তি হলেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়া নাগরিকের অধিকার৷
৩.
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি হয় এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, সদাচরণ এবং প্রতিষ্ঠানটির নিষ্ঠার মধদিয়ে৷
সততা নিয়ে প্রশ্ন সব সময় কমবেশি ছিল৷ যখন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল তখনো এর গুটিকয় কর্মকর্তার নামে দুনীতির অভিযোগ ছিল৷ দুদক হওয়ার পরেও বিভিন্ন সময় কর্মকর্তাদের নামে অভিযোগ ওঠে৷ এই তো কয়েক মাসে আগে, ২০১৯ সালের জুন মাসে পুলিশের একজন ডিআইজি অভিযোগ করেন, দুদকের মামলা থেকে বাঁচিয়ে দিতে তদন্তকালে দুদকের একজন পরিচালক তাঁর কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন৷ এ ঘটনায় দুদকের তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে৷ তাহলে কি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা চাইলেই ঘুষের বিনিময়ে কাউকে রেহাই দিতে পারেন কিংবা ঘুষ না পেয়ে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন? সেই প্রশ্নের কোনো সুরাহা এখন অবধি হয়নি৷ আদালত গত বুধবার উভয়কেই দণ্ড দিয়েছেন৷ এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, তদন্তকালে ঘুষ গ্রহণের চর্চা বিদ্যমান রয়েছে৷ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দুদক কর্মকর্তার মধ্যে ঘুষ লেনদেনের এই ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে৷ এ রকম যে খবরগুলো অগোচরে রয়ে যায়, তার কি হবে?
এবার আসি নিষ্ঠার প্রশ্নে৷ কাজ দিয়ে দুদক এখন পর্যন্ত আস্থা অর্জন করতে পারেনি৷ তাঁদের উদাহরণ সৃষ্টি করা কাজের সংখ্যা সহজে মনে করা যায় না৷ এ কথা সবাই জানে এবং আলোচনা করে যে, দুদকের জালে কোনো রাঘববোয়াল, রুই, কাতলা ধরা পড়ে না৷ কেবল কিছু চুনোপুঁটি ওঠে৷ এত বড় একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, এত লোকবল, এত বিনিয়োগ, তার ফলাফল রীতিমতো শোচনীয়৷ বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না দুদক৷ আলোচিত বেসিক ব্যাংকের দুনীতির প্রশ্নে চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুদক অসহায়৷
অপরদিকে দুদকের ভুল তদন্তে পাটকল শ্রমিক জাহালমকে তিন বছর কারাবাস করতে হয়৷ নামের মিল থাকায় বিনা অপরাধে এক বছর কারাগারে কাটাতে হয় দিনমজুর শুক্কুর শাহকে৷ যেসব কর্মকর্তা এই ভুল তদন্তের সঙ্গে যুক্ত তাদের কোনো সাজা হয় না৷
শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির পর অবধারিতভাবে এই প্রশ্ন চলে আসে, তবে কি দুদক দুষ্টের পালন আর শিষ্টের দমন করছে? দুদককে ১০০ তে পাশ মার্ক ৩৩ দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে৷
৪.
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি৷ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজে ন্যূনতম সাম্য প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি বিরাট বাধা৷ আমাদের দেশটা গরিব৷ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছি বটে, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি আজও৷ সমাজের শরীরে ঢুকে আছে দুর্নীতির ভাইরাস৷ আজ অবধি এমন কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে এই ভাইরাসকে মেরে ফেলা যায়৷
কিন্তু সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রত্যাশা করি৷ এখানেই দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা জোরালো হয়ে ওঠে৷ কিন্তু সেই ভূমিকাটা দুদক রাখতে পারছে না৷ দুনীতির বিরুদ্ধে শক্ত অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না৷
আমরা এটা আশা করি না, দুদক রাতারাতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই বা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই হয়ে যাবে৷ কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে৷
একই সঙ্গে এ কথাটি আমরা বলতে চাই, দুদককে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে৷ এ রকম করা হলে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা তৈরি হবে না৷
আমরা চাই, অসৎ সরকারি কর্মকর্তাদের মনে দুদক ভীতি তৈরি হোক৷
দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার৷ কারণ এখন একেকজন অফিসারের হাতে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি৷ অতিরিক্ত মামলা তদন্ত কর্মকর্তাকে দায়সারা তদন্তে উৎসাহিত করতে পারে৷
আইনসংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, দুদকের প্রসিকিউশন বিভাগকে আরও শক্তিশালী হতে হবে৷ অনেক সময় উচ্চ আদালত থেকে দুদকের মামলার আসামিরা জামিন পেলেও দুদক কিছু জানতে পারে না৷ এটা একটা বড় ঘাটতি৷
দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি দরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা, আলোচনা ও শিক্ষা৷ সেই কাজটি মোটেই দৃশ্যমান নয়৷
এই অভিমত প্রকাশের শেষলগ্নে এসে রাজনীতির কথা জোর দিয়ে বলতে হয়৷ কেবলই আইনি সুরক্ষা আর প্রয়োজনীয় লোকবলই বাংলাদেশের মতো সীমিত গণতন্ত্রের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেয় না৷ রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা খুব প্রয়োজন হয়৷ আর দুদকের মতো এসব প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান ব্যক্তি, তাঁকে হতে হয় আপসহীন, অনমনীয় মানসিকতার৷ দুই জায়গাতেই বাঁধন ঢিলেঢালা৷ পাস মার্ক পেতে আর কত দিন লাগবে দুদকের?