কিছুদিন আগেও রেডিও–টিভিতে শোনা যেত বিজ্ঞাপনী নারীকণ্ঠ, সেখানে জানানো হতো, খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করলে স্বাস্থ্যহানির কী কী শঙ্কা থাকে, কেন বাড়িতে শৌচালয় থাকাটা জরুরি৷ সম্প্রতি শুরু হয়েছে নতুন এক বিজ্ঞাপন, সেখানে একজন নতুন টিভি কিনবেন বলছেন, আর তাঁর ছোট ছেলে বলছে, যে কোনো একটা টিভি কিনে নিলেই হয়৷ সে টিভি তো আর দেখা হবে না! বাবা অবাক হয়ে ছেলেকে বলছেন, টিভি কিনব, অথচ দেখব না মানে! ছেলের জবাব, সে তো বাড়িতে শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও তুমি খোলা মাঠেই শৌচকাজ করতে যাও!
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান' এখনো তার প্রাথমিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচি চালু করার সময় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিকের বাড়িতে শৌচালয় তৈরি এবং তা নিয়মিত ব্যবহারের অভ্যাস নিশ্চিত করে দেবেন৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd এই প্রথম নয়, এর আগেও ভারত সরকার এই একই উদ্যোগ নিয়েছিল, যার সময়সীমা ফুরিয়ে গেছে ২০১২ সালে৷ কিন্তু নাগরিকদের সুঅভ্যাস গড়ে তোলা যায়নি৷ হালের এই নতুন বিজ্ঞাপনও বলছে, যদিও বা বাড়িতে শৌচালয় তৈরি করানো গেছে, কিন্তু মাঠে যাওয়ার অভ্যাস ছাড়ানো যায়নি৷ এর আগে ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, সরকারি তাগাদায় পাকা শৌচালয় তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ভারতের ৩০ শতাংশ বাড়িতে সেগুলি স্রেফ অব্যবহারে, বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায়, বদ্ধ অবস্থায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে৷ এই প্রকল্পের পরিকল্পনা স্তরেও প্রচুর ত্রুটি–বিচ্যুতি ছিল, যা যে কোনো প্রকল্পের সাফল্যের ক্ষেত্রেই অন্তরায়৷
যেমন প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, সরকার গ্রামে গ্রামে প্রচুর শৌচালয় গড়ে দেবে, চাহিদার কথা না ভেবেই৷ তারপর ঠিক হলো, যেখানে যেমন চাহিদা, সেই অনুযায়ী শৌচালয় গড়া হবে৷ তারপর সেটাও বদলে গিয়ে নতুন নীতি হলো, জনবসতির ঘনত্ব অনুযায়ী শৌচালয় গড়ে দেওয়া হবে৷ ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রকল্প, অর্থাৎ সারা দেশের পয়ঃপ্রণালি ও নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি এবং পরোক্ষে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি, তা হওয়ার সুযোগ হলো না৷ এর পাশাপাশি, এই প্রকল্প খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্প রূপায়ণের সময় ব্যাপক দুর্নীতি এবং টাকা নয়ছয়ের ঘটনা ঘটছে, জানিয়েছিল সিএজি৷
কলকাতার জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি৷ তার ১০ শতাংশ, মানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ফুটপাথে থাকেন৷ এঁদের একটা অংশ ঠেলা বা রিকশা চালক, কুলি মজুর, যাঁরা রুটি-রুজির তাগিদে এই শহরে থাকেন৷ বাকিদের জন্ম থেকে মৃত্যু কাটে রাস্তার ধারেই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayরাস্তায় হলেও প্রত্যেক পরিবারের থাকার নির্দিষ্ট জায়গা থাকে৷ তার মধ্যেই গুছনো সংসার৷ রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর, সব একেবারে গেরস্তবাড়ির মতই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayরাস্তায় জন্ম, চূড়ান্ত দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা, তবু অমলীন থাকে শৈশবের হাসি৷ এটাই অবাক করা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayসকলেই পথবাসী, কিন্তু ভাগ্যবান কেউ কেউ পেয়ে যায় মাথার ওপর ছাদ৷ যেমন দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের এই ফ্লাইওভার৷ গোটা ২০ পরিবারের বাস এর তলায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayসংসারের পুরুষ-মহিলারা সবাই কিছু না কিছু খুচরো কাজ করেন৷ রাস্তার সংসার সামলানোর জন্যে থেকে যান বয়স্ক আর শিশুরা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayসরু একফালি বুলেভার্ডে নড়াচড়ার জায়গা থাকে না৷ দুধারের রাস্তা দিয়ে দিনরাত ছুটে চলে ব্যস্ত ট্রাফিক৷ কিন্তু উপায় কী? তার মধ্যেই পথবাসীদের ঘরবাড়ি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayওদের নিশ্চয়ই কোনো চিঠি আসে না৷ কোন ঠিকানায় আসবে? আজ এই ফুটপাথে বাস, তো কালই হয়ত খেদিয়ে দিল পুলিস৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayতবু রোজ ফুটপাথের সংসারে উনুনে আগুন পড়ে, হাঁড়ি চড়ে, রান্না চাপে৷ ক্ষিদের আগুন তো কখনও মরে না৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay অন্যদিকে সামগ্রিক যে পরিচ্ছন্নতা, তারও কোনো উন্নতি হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে শুরু করে শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি, সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন, সবাই সরকারি বিজ্ঞাপনে ঝাড়ু হাতে ‘পোজ' দিয়েছেন৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ বহু কোটি টাকা খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনে, কিন্তু সেভাবে জনশিক্ষা প্রসারিত হয়নি৷ এখনো রাস্তায় জঞ্জাল ফেলার যথেষ্ট জায়গা নেই, সাফাইকর্মীরা যথেষ্ট দায়িত্বশীল নয় এবং সব থেকে বড় কথা, সাধারণ নাগরিক তাদের রোজকার জঞ্জাল ফেলার সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে পারেনি এখনও ৷ ভারতের মতো এক বিশালায়তন, বহুল জনসংখ্যার দেশ যখন এই পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস রপ্ত করতে পারে না, তখন সমস্যা আরও বড় চেহারা নেয়৷ যে কারণে এর আগেও বার বার এ ধরনের সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে৷
১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় গ্রামীণ নিকাশি প্রকল্প, ১৯৯৯ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় জাতীয় নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প৷ কোনোটাই সফল হয়নি৷ মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত' অভিযানের সময়সীমা ফুরোবার যদিও আরও তিন বছর বাকি, কিন্তু শুরুর দু'বছরের সাফল্য আদৌ আশাজনক নয় এবং তার জন্য সরকারি গাফিলতির থেকেও বেশি অপরাধী সাধারণের মানসিকতা৷ যদিও নাগরিকদের একাংশ পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝেন, কিন্তু একটা বড় অংশই বোঝেন না৷ অপরিচ্ছন্ন বাসস্থান এবং পরিবেশ যে স্বাস্থ্যহানি, রোগব্যাধির কারণ হয়, এটা তাঁরা বুঝতে চান না৷
ফলে দাবি উঠেছে, বিশেষত সমাজকর্মীদের থেকে, যে বিখ্যাত চিত্রতারকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন নয়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতে হবে৷ সচেতনতা প্রসারের উদ্যোগ আরও সুসংহত এবং ঘনীভূত করতে হবে, যাতে লোকে বোঝে, বিষয়টা শুধু পরিচ্ছন্নতার নয়৷ ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যই এটা জরুরি৷