1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিবাংলাদেশ

দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্সের বিপরীতে দুর্নীতির ‘অবাধ' সুযোগ

সমীর কুমার দে ঢাকা
৫ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ সংশোধন করে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সচিবালয়
চাকরির শুরুতে সম্পদের বিবরণী দিলেও, পাঁচ বছর পর পর হিসাব হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা গুরুত্বই দেন না সরকারি কর্মচারিরাছবি: bdnews24.com

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে প্রায় ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারীকে জবাবদিহিতা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স' নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের তফসিল ঘোষণার সময় বলেছিলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তার সরকারের নীতি হবে জিরো টলারেন্স। বাস্তবে কি এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পিক অ্যান্ড চুজ নীতি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় বাধা। আপনি সরকারি দলের সমর্থক হলে দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাবেন। আবার বিরোধী মতাদর্শের হলে আইনের আওতায় আসবেন, এটা তো হতে পারে না। বর্তমান সরকারের আমলে এক শ্রেণির মানুষের জন্য দুর্নীতির উর্বরভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নীতি হয়ত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শুনছেন না। শুধু বেনজীর আহমেদ না, খোঁজ নিলে এমন শত শত ব্যক্তির সন্ধান মিলবে।”

সর্বশেষ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের বিষয়টি সামনে আনে ঢাকার জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠ। তাদের অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদের দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের খোঁজ মেলে। সকল সম্পত্তি তিনি স্ত্রী ও কন্যাদের নামে করেছেন। এরপর সামনে এসেছে গাজীপুরের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আওলাদ হোসেনের দুর্নীতির বিষয়টি। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০২ নম্বর রোডের ৬০ নম্বর প্লটে পূর্বাচল ড্রিম সুইম অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে একটি রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন। এই রিসোর্টে মেলে বাহারি খাবার, বিশাল সুইমিংপুল ও বিশ্রামের জন্য আরামদায়ক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ। একজন সরকারি কর্মকর্তা কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন?

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে কারও সম্পদের অনুসন্ধানের বিষয়টি তার একার উপর নির্ভর করে না। কমিশন বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর সিদ্ধান্ত হয়।”

আপনি সরকারি দলের সমর্থক হলে দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাবেন: মনজিল মোরশেদ

This browser does not support the audio element.

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মনে করেন দুর্নীতি নির্মূল করার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা ঠিক নয়, "এটা একেবারেই ঠিক না। যদি করা হয়, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। আবার এটাও বুঝতে হবে, দুদক চাইলেই সব ব্যক্তির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়। তবে যেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়, সেগুলোর তো অনুসন্ধান করাই যায়।”

একে তো সরকারি কর্ম      কর্তাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তার মধ্যে আবার সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর সংশোধন করে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রায় ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারীকে জবাবদিহিতা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের খসড়া সংশোধনী যাচাইয়ের পর এটি এখন প্রশাসনিক উন্নয়নবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নিলে দুর্নীতি সুরক্ষিত এবং উৎসাহিত হবে কিনা জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ ধরনের সংশোধনী সরকারের নির্বাচনি অঙ্গীকার ও শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণার ঠিক উলটো। প্রথমে প্রতি বছর সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও সরকারি কর্মচারিদের অনীহার মুখে পরবর্তীতে শিথিল করে তা পাঁচ বছর পর পর দেওয়ার বিধান করা হয়। সেই বিধানও সঠিকভাবে পালনে অনাগ্রহ ছিল। চাকরির শুরুতে সম্পদের বিবরণী দিলেও, পাঁচ বছর পর পর হিসাব হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা গুরুত্বই দেন না সরকারি কর্মচারিরা। এখন এই বাধ্যবাধকতা সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো প্রকারান্তরে তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করা। কারণ, সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার মতো কোনো বিধান না থাকলে তাদের মধ্যে নির্ভয়ে দুর্নীতি, এর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুযোগ বাড়বে। একই সঙ্গে সেবা পেতে সরকারি অফিসে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে।”

দুর্নীতি দমন কমিশন গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে ১ হাজার ৭৮২টি মামলা করেছে। মামলাগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক দিন ধরেই দুর্নীতি দমন কমিশনে রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নামে অভিযোগ আসছে। কিছু কিছু অভিযোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে। নেতাদের মধ্যে কেউ সংসদ সদস্য, কেউ সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও জেলা-উপজেলার নেতা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, অধস্তন কর্মচারী ও সাবেক আমলা রয়েছেন।

চাকরিতে থেকে সরকারি কর্মচারিরা কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে সেটা দেখার দায়িত্ব কার? সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কারণ আইন সবার জন্য সমান। একজন কর্মচারি যে বিভাগে চাকরি করেন, সেই মন্ত্রণালয় প্রথমত দেখবে। এর বাইরে সবাইকে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। সেখানে এনবিআর বিষয়টি দেখতে পারে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন তো আছেই। তবে কথা হচ্ছে, এনবিআরের পক্ষে ১৬ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির সবার আয়কর রিটার্ন দেখা সম্ভব না। প্রভাবশালীদেরগুলোতো তারা দেখেই না। তবে কারও বিষয়টি সামনে এলে সেটা অবশ্যই এনবিআর বা দুদকের দেখা উচিৎ।”

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও জবাবদিহিতা থাকতে হবে: আলী ইমাম মজুমদার

This browser does not support the audio element.

দুর্নীতির টাকার অধিকাংশই বিদেশে পাচার হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশের ছেলে-মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে। ফলে ওই দেশে তারা বাড়ি-ঘর কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের আয়োজন করেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি ও হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ পাচার মনিটরিং সংস্থা- বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) প্রতিবেদনেও এমনটাই উঠে এসেছে।

বিদেশে টাকা পাচার কেন থামানো যাচ্ছে না? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন অনেকেরই বিদেশে একটা সংসার আছে। তারা স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে সেখানে রেখেছেন। ফলে ওই সংসারটা চালাতে তাকে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। বৈধ উপার্জন দিয়ে এটা পরিচালনা করা কঠিন। আবার অনেকেরই অবৈধ টাকা আছে। সেই টাকা দেশে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। তারা সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেখানে তারা বাড়ি-ঘর কিনছেন। স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে রাখছেন। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যঅর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। এর বাইরেও আরেকটা শ্রেণি আছে, তারা বৈধ টাকাও বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। যেমন ধরেন কেউ বিদেশে পড়াশোন করেন। দেশে তার বাবার বাড়ি আছে। সেই বাড়ি বিক্রি করে টাকা তিনি বৈধ বা অবৈধপথে বিদেশে নিচ্ছেন। এই টাকা তিনি দেশে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশটাও আরও ভালো করা দরকার। বিদেশ থেকে যারা দেশে বিনিয়োগ করবেন তাদের নানা ধরনের প্রনোদনা দিতে হবে। তাহলে হয়ত বৈধ যে টাকাগুলো বিদেশে যাচ্ছে, সেগুলো অন্তত ঠেকানো যেতো।”

শুধু বেনজীর বা আওলাদ না, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনার দেড়শ' কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য মিলেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। আবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের আলোচিত গাড়িচালক আব্দুল মালেক ও তার স্ত্রীরও বিপুল পরিমান সম্পদের তথ্য মিলেছে। এদের বিরুদ্ধেও দুদক মামলা করেছে। আবার সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্রিটেনে ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ' আছে বলে খবর বের হয়। নির্বাচনের আগে টিআইবি দাবি করে, এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা নেওয়া জটিল প্রক্রিয়া হলেও ভূমিমন্ত্রী কিভাবে বিদেশে এতো সম্পদ গড়ে তুলেছেন সেটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও সাইফুজ্জামান চৌধুরী দাবি করেছেন, একটি টাকাও তিনি দেশ থেকে নিয়ে যাননি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও আমলে নেয়নি দুদক। আবার নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুসহ বেশ কিছু সরকার দলীয় নেতার দুর্নীতির অনুসন্ধান চালিয়েও কোনো তথ্য পায়নি দুদক। তাদের ‘দুর্নীতিমুক্ত'র সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় অবসরপ্রাপ্ত সচিব প্রশান্ত কুমার রায়কে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ১ কোটি ২০ লাখ ৪৯ হাজার ৮১৬ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৫ জুন সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়। প্রশান্ত কুমার রায় ২০১৬-১৭ সালের দিকে সচিব হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। প্রশান্ত কুমারের দুই মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি অবৈধভাবে টাকা পাঠিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে দুদক।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ