বিদেশি-বহিরাগত হিসেবে জার্মানিতে ৩৬ বছর ধরে বাস করে কোনোদিন দুর্নীতির মুখোমুখি হতে হয়নি; কাউকে পান খাবার পয়সা দিতে হয়নি; কোনো কাজের জন্য কাউকে টেলিফোন করতে হয়নি৷ কিন্তু কেন?
বিজ্ঞাপন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৫ সালের ‘করাপশন পার্সেপসন', মানে দুর্নীতি বোধ ইন্ডেক্সে জার্মানির স্থান – ১৬৮টি দেশের মধ্যে – দশ নম্বরে৷ ইন্ডেক্সটা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে৷ শূন্য (দুর্নীতিপরায়ণ বলে অনুভূত) থেকে একশো (আদৌ দুর্নীতিপরায়ণ নয়) – এই স্কেলে ৮১ পয়েন্ট পেয়েছে জার্মানি৷ জি-টোয়েন্টি দেশগুলোর মধ্যে ক্যানাডার পরেই দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি ও ব্রিটেন, যৌথভাবে৷
আন্তর্জাতিক বিচারে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন প্রথম তিনটি স্থানে, তবে এগুলো ছোট দেশ; আয়তন, অর্থনীতি বা জনসংখ্যা, সব বিচারেই জার্মানির চেয়ে অনেক ছোট৷ সে তুলনায় ইউরোপ তথা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অর্থনীতিগুলির মধ্যে একটি, ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্রের মতো একটি দেশ দুর্নীতি থেকে বাঁচল কিভাবে, সেটাই হলো প্রশ্ন৷ অন্তত আমরা যারা উপমহাদেশ থেকে এসেছি, তাদের কাছে তো বটেই৷
জার্মানিতে দুর্নীতি নেই, এমন বলা চলে না৷ তবে দুর্নীতির রকমফের আছে৷ জার্মানিতে দুর্নীতি যেমন জঙ্গলে বড় বড় বাঘ-সিংঘি ঘুরে বেড়ায়, সেরকম – কিন্তু মশার কামড় কিংবা জোঁকের রক্ত চোষা নেই৷ জার্মানিতে দুর্নীতি যেন মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার৷ কোথাও ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে কেলেঙ্কারি – অর্থাৎ ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার পাবার জন্য জার্মান কর্মকর্তাদের তরফ থেকে কোনোরকম বেআইনি বদান্যতা বা অর্থানুকুল্য প্রদর্শন করা হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, অভিযোগ-অনুযোগ, তদন্ত-পদত্যাগ৷
আপাতত চলেছে ফক্সভাগেন কোম্পানির কেলেঙ্কারি৷ এর আগে ছিল ডয়চে ব্যাংক কিংবা সিমেন্স কোম্পানিকে নিয়ে কেলেঙ্কারি৷ বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে জার্মানিতে চিরকালই একটা সমস্যা – একটা কেন, দুটো সমস্যা – লেগেই থাকে: প্রথমে যে খরচ ধরা হয়েছিল, শেষমেষ তার তিন-চারগুণ বেশি ব্যয় হওয়াটা এদেশে খুব অস্বাভাবিক নয়; দ্বিতীয়ত, নির্মাণকাজ যতদিনে শেষ হবার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগে যায় – ক্ষেত্রবিশেষে বছরের পর বছর, যেমন বার্লিনের পরিকল্পিত ‘বিইআর' বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বা হামবুর্গ ফিলহারমনিকের ক্ষেত্রে৷
সেরা দশ দুর্নীতির দেশ, সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ
এক সময়ের দুর্নীতির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ এবার হয়েছে ১৩তম৷ চলুন দেখা যাক ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)-র প্রতিবেদনে এবার কোন কোন দেশ আছে দুর্নীতির সেরা দশে আর কোন দশটি দেশে এখন দুর্নীতি সবচেয়ে কম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
৮ থেকে ১০ নম্বরে কঠিন লড়াই
টিআইবি-র এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমান ১৮ পয়েন্ট করে পাওয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দশটি দেশের তালিকায় ৮ নাম্বার থেকে ১০ নাম্বার পর্যন্ত স্থানে রয়েছে উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
দুর্নীতির সপ্তম স্বর্গে তুর্কমেনিস্তান
উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়ার চেয়ে মাত্র এক পয়েন্ট কম হওয়ায় দুর্নীতিতে সেরা দশটি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান৷
ছবি: DW
ইরাকের দুরবস্থা
যুদ্ধ, হানাহানির মাঝে ইরাকে দুর্নীতিও চলছে পুরোদমে৷ তাই ১৬ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন দুর্নীতিতে সেরা দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: Reuters
পঞ্চম স্থানে দক্ষিণ সুদান
ইরাকের পরেই রয়েছে সদ্য স্বাধীন দেশ দক্ষিণ সুদান৷ তারা পেয়েছে ১৫ পয়েন্ট৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Karumba
আফগানিস্তান দুর্নীতিরও স্থান
দুর্নীতিরও স্থান না হলে আফগানিস্তান কি আর ১২ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হতো?
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
দক্ষিণ সুদানের চেয়ে দুর্নীতিতে এগিয়ে সুদান
সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান শুধু মানচিত্রেই নয়, দুর্নীতিতেও কিছুটা ব্যবধান দেখাতে পেরেছে৷ দক্ষিণ সুদান যখন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে, সুদান তখন ১১ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়৷ দুর্নীতিতে এগিয়ে থাকা তো আর ভালো কথা নয়!
ছবি: getty / C. Bouroncle
উত্তর কোরিয়া আর সোমালিয়া
সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে হোঁচট খেয়ে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়লেও দুর্নীতিতে খুব এগিয়েছে উত্তর কোরিয়া৷ আফ্রিকার দারিদ্র্য জর্জরিত দেশ সোমালিয়াও কম যায় না৷ ৮ পয়েন্ট করে নিয়ে এই দুই দেশই আছে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Sinmun
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক
নারীর জন্য সবচেয়ে ভালো দেশ হওয়ার পর, এবার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশও হয়েছে ডেনমার্ক৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশ পেয়েছে ৯২ পয়েন্ট৷
ছবি: Reuters/N. Ahlmann Olesen
দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ড, তৃতীয় ফিনল্যান্ড
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশগুলোর মাঝে নিউজিল্যান্ড ৯১ পয়েন্ট নিয়ে আছে দ্বিতীয় স্থানে আর ৮৯ পয়েন্ট পেয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance / Robert Harding
চতুর্থ স্থানে সুইডেন
আরেক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনও কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর মাঝে খুব ভালো অবস্থানে৷ তাদের পয়েন্ট ৮৭, অবস্থান চতুর্থ৷
ছবি: DW/T. Mehretu
নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ডে সমতা
৮৬ পয়েন্ট করে পেয়েছে নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ড৷ ফলে দেশ দু’টি আছে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: EBU
একের হেরফেরে সাত থেকে দশ
সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দশ দেশের তালিকায় সপ্তম থেকে দশম স্থানে আছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ এবং ক্যানাডা৷ সপ্তম থেকে দশম, অষ্টম, নবম ও দশমে মাত্র এক পয়েন্ট করে ব্যবধান৷ সিঙ্গাপুরের ৮৪, নেদারল্যান্ডসের ৮৩, লুক্সেমবুর্গের ৮২ এবং ক্যানাডার পয়েন্ট ৮১৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
12 ছবি1 | 12
ব্যক্তিগত দুর্নীতির ক্ষেত্রেও দেখা যাবে ঐ বাঘ-সিংঘিরাই বেশি হালুম করেন ও ধরা পড়েন৷ ট্র্যাফিক পুলিশ বা ট্রেনের গার্ডসাহেব এখানে হাত বাড়িয়ে থাকেন না – কিন্তু কর ফাঁকি দেওয়ার খাতায় উলি হোয়নেস, স্টেফি গ্রাফ, বরিস বেকার ইত্যাদি রথী-মহারথীর নাম পাওয়া যাবে৷ এদেশে ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ-এর মতো প্রেসিডেন্ট বন্ধুকে দিয়ে হোটেলের বিল চোকাতে গিয়ে চাকরি খোয়ান৷ সংসদসভাপতি বা মন্ত্রী-সান্ত্রী সরকারি বিমানে এদিক-সেদিক ঘুরে আসেন৷ বিধানসভার সদস্যরা স্ত্রী-কন্যাকে – বৈধভাবেই – কর্মচারী হিসেবে দেখিয়ে নিন্দে-মন্দর ভাগিদার হন৷ সরকারি জল অথবা বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির চেয়ারম্যানের পদটি রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পালা করে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া হয়৷ এ সবই যাকে বলে কিনা মানবিক দুর্বলতা!
কিন্তু সাধারণভাবে জার্মানিতে বেকারত্ব কম, মাইনেপত্তর ভালো বললেও কম বলা হয়; বাসস্থান, ডাক্তার কিংবা ডাক্তারখানা; ওষুধপত্র, হাসপাতাল কিংবা অস্ত্রোপচার; গ্যাস বা টেলিফোন, কোনো কিছুর জন্যেই তদবির, উমেদারি, ধরাধরি, বড় সাহেবকে বলা, এ সব করতে হয় না৷ জীবনের সব কাজ – সব না হলেও, প্রায় সব কাজ চলে সিস্টেমে৷ জার্মানরা মানুষে না বিশ্বাস করে, পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেন, প্রণালীতে বিশ্বাস করেন৷ তাই এদেশে সব কাম-কার্য চলে পদ্ধতি অনুযায়ী – সেখানে দুর্নীতির স্থান কোথায়?
যে দেশে একজন বাস ড্রাইভার কিংবা বাস কন্ডাক্টর খান-দান-থাকেন একজন থানার দারোগা কিংবা ইউনিভার্সিটির লেকচারারের সঙ্গে সমান পর্যায়ে, সেদেশে খুচরো দুর্নীতির স্থান নেই৷ গোটা দেশটাই মধ্যবিত্ত: ওদিকে কিছু ভাতা-মাসোহারা পাওয়া কর্মহীন, এদিকে কিছু বিত্তশালী৷ বাকিটা সমৃদ্ধি আর সুশাসনের রাজ৷ সে রাজত্বে দুর্নীতি দূরীকরণের প্রয়োজন পড়ে না৷ দুর্নীতি সেখানে বাসা বাঁধার, ডিম পাড়ার কিংবা বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পায় না৷
আপনি কি অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর সঙ্গে একমত? জানান আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার পাঁচ কৌশল
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷