‘‘বাংলাদেশের আত্ম-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি একেবারে কমানো না গেলেও, একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি৷ সেটা হলেই নিজেদের সার্থক মনে করব৷'' বললেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু৷
বিজ্ঞাপন
[No title]
বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজা হওয়ার হার ৪৭ ভাগ, আগে যেখানে ছিল ১৫ থেকে ২০ ভাগ৷ ‘‘এটাকে আমরা ৯০ ভাগের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাই৷'' ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদুক-এর কমিশনার৷ সেই সাক্ষাৎকারেরই কিছু অংশ তুলে ধরা হলো৷
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু: আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অকার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করার চেষ্টা করছি৷ কমিশন গঠন হওয়ার পর ২০০৪ সাল থেকে এটিকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের (১/১১) পর সরকার এই কমিশনকে অন্যভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে৷ গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর, আমরা বলতে গেলে প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছি৷ আমাদের নিরন্তন প্রচেষ্টা দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ৷ বাংলাদেশের আত্ম-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি যে একেবারে কমানো সম্ভব – এটা আমি বিশ্বাস করি না৷ আমার অভিজ্ঞতাও তা বলে না৷ আমরা দুর্নীতিকে যদি একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমরা মনে করব যে আমরা অনেকটাই সার্থক৷ আমরা কাজ করে যাচ্ছি৷ প্রতিরোধের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি৷ ‘ফাইনালশিয়াল সেক্টরে' দুর্নীতি অনেক কমে এসেছে৷ বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠানকে ধরতে সক্ষম হয়েছি আমরা৷ এখন ঋণের ক্ষেত্রে ফ্রড, প্রতারণা, জালিয়াতি অনেকাংশে কমে এসেছে৷ টিআইবি-র দুর্নীতির সূচকে গতবার আমাদের যে অবস্থা ছিল, এবারও সেই অবস্থানে আছে৷ অর্থাৎ কোনো অবনতি হয়নি৷ আমাদের ‘অ্যাগ্রেসিভ' কার্যক্রমের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার পাঁচ কৌশল
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷
ছবি: Getty Images
5 ছবি1 | 5
আপনি বলছিলেন, প্রতিরোধ কমিটি কাজ করছে৷ তাহলে কেন আমরা সামনের দিকে এগোতে পারছি না?
এখানকার বাস্তবতার নিরিক্ষে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে৷ এ সব সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা এগোতে পারছি না৷ আমাদের জনবলের অভাব রয়েছে৷ বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের মাত্র ২৩টি জেলায় অভিস ছিল৷ এখনও ৪-৫টি জেলা মিলিয়ে একটি অফিসে কাজ করতে হয়৷ এটাতে আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে৷ এর সঙ্গে আমাদের জনবলেরও সমস্যা আছে৷ এ সব কারণে আমরা যতটা কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছি, ততটা সম্ভব হয়নি৷
একটা অভিযোগ আপনাদের বিরুদ্ধে সব সময় দেয়া হয় যে, সরকারি দলের নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ আসলে আপনারা প্রমাণ খুঁজে পান না৷ অথচ বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে, বিচার হচ্ছে, এটা কেন? আপনি যে বলছিলেন, আপনারা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন?
সেরা দশ দুর্নীতির দেশ, সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ
এক সময়ের দুর্নীতির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ এবার হয়েছে ১৩তম৷ চলুন দেখা যাক ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)-র প্রতিবেদনে এবার কোন কোন দেশ আছে দুর্নীতির সেরা দশে আর কোন দশটি দেশে এখন দুর্নীতি সবচেয়ে কম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
৮ থেকে ১০ নম্বরে কঠিন লড়াই
টিআইবি-র এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমান ১৮ পয়েন্ট করে পাওয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দশটি দেশের তালিকায় ৮ নাম্বার থেকে ১০ নাম্বার পর্যন্ত স্থানে রয়েছে উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
দুর্নীতির সপ্তম স্বর্গে তুর্কমেনিস্তান
উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়ার চেয়ে মাত্র এক পয়েন্ট কম হওয়ায় দুর্নীতিতে সেরা দশটি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান৷
ছবি: DW
ইরাকের দুরবস্থা
যুদ্ধ, হানাহানির মাঝে ইরাকে দুর্নীতিও চলছে পুরোদমে৷ তাই ১৬ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন দুর্নীতিতে সেরা দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: Reuters
পঞ্চম স্থানে দক্ষিণ সুদান
ইরাকের পরেই রয়েছে সদ্য স্বাধীন দেশ দক্ষিণ সুদান৷ তারা পেয়েছে ১৫ পয়েন্ট৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Karumba
আফগানিস্তান দুর্নীতিরও স্থান
দুর্নীতিরও স্থান না হলে আফগানিস্তান কি আর ১২ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হতো?
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
দক্ষিণ সুদানের চেয়ে দুর্নীতিতে এগিয়ে সুদান
সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান শুধু মানচিত্রেই নয়, দুর্নীতিতেও কিছুটা ব্যবধান দেখাতে পেরেছে৷ দক্ষিণ সুদান যখন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে, সুদান তখন ১১ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়৷ দুর্নীতিতে এগিয়ে থাকা তো আর ভালো কথা নয়!
ছবি: getty / C. Bouroncle
উত্তর কোরিয়া আর সোমালিয়া
সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে হোঁচট খেয়ে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়লেও দুর্নীতিতে খুব এগিয়েছে উত্তর কোরিয়া৷ আফ্রিকার দারিদ্র্য জর্জরিত দেশ সোমালিয়াও কম যায় না৷ ৮ পয়েন্ট করে নিয়ে এই দুই দেশই আছে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Sinmun
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক
নারীর জন্য সবচেয়ে ভালো দেশ হওয়ার পর, এবার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশও হয়েছে ডেনমার্ক৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশ পেয়েছে ৯২ পয়েন্ট৷
ছবি: Reuters/N. Ahlmann Olesen
দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ড, তৃতীয় ফিনল্যান্ড
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশগুলোর মাঝে নিউজিল্যান্ড ৯১ পয়েন্ট নিয়ে আছে দ্বিতীয় স্থানে আর ৮৯ পয়েন্ট পেয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance / Robert Harding
চতুর্থ স্থানে সুইডেন
আরেক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনও কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর মাঝে খুব ভালো অবস্থানে৷ তাদের পয়েন্ট ৮৭, অবস্থান চতুর্থ৷
ছবি: DW/T. Mehretu
নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ডে সমতা
৮৬ পয়েন্ট করে পেয়েছে নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ড৷ ফলে দেশ দু’টি আছে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: EBU
একের হেরফেরে সাত থেকে দশ
সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দশ দেশের তালিকায় সপ্তম থেকে দশম স্থানে আছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ এবং ক্যানাডা৷ সপ্তম থেকে দশম, অষ্টম, নবম ও দশমে মাত্র এক পয়েন্ট করে ব্যবধান৷ সিঙ্গাপুরের ৮৪, নেদারল্যান্ডসের ৮৩, লুক্সেমবুর্গের ৮২ এবং ক্যানাডার পয়েন্ট ৮১৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
12 ছবি1 | 12
এটা একটা অমূলক ধারণা৷ আমরাই একমাত্র কমিশন, যাদের কাছে সরকারি দল, বিরোধী দল বা আমলা বলে কিছু নেই৷ আমাদের কাছে পরিচয় হচ্ছে, অপরাধের ধরণ ও অপরাধী৷ আমরা অপরাধ ও অপরাধীকে নিয়েই কাজ করি৷ এই ধরনের কথা যারা বলেন, তারা মান্ধাতার আমলের মানসিকতা নিয়েই বলেন৷ এ দেশে যেসব কথা বললে রাজনৈতিকভাবে মানুষকে প্রভাবিত করা যাবে বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে, সেই ধরনেরই কথা বলা হয়৷ আমরাই পেরেছি বর্তমান পার্লামেন্টের মেম্বারকে কারাগারে পাঠাতে৷ ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী বা এমপিকে কি দুদক-এর বারান্দায় আসতে হয়েছে? আমরাই অনেক সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি৷ এখন তারা বিচারের সম্মুখীন৷ পাশাপাশি অনেক আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি এবং এর ফলে তারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন৷
দুদক-এর পক্ষ থেকে যে মামলাগুলো করা হয়, চার্জশিট দাখিলের পর সে সব মামলার বিচারে সফলতার হার কেমন?
দুদক-এর দায়ের করা মামলায় ৪৭ শতাংশের বিরুদ্ধে সাজা হচ্ছে৷ আগে যেখানে এটা ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ৷
সাজার হার ৪৭ ভাগ থেকে বাড়িয়ে কবে আমরা শতভাগ দেখব?
না, এটা আশা করি না, সম্ভবও না৷ কিছু ত্রুটি তদন্তে থেকেই যায়৷ পরে বিচারে সেটা ধরা পড়ে৷ এটাকে বলা হয় ‘সিস্টেম এরর'৷ তবে হ্যাঁ, আমরা আশা করব এটা যেন ৯০ ভাগের কাছাকাছি আসে৷
বন্ধু, আপনি কি দুদক কমিশনারসাহাবুদ্দিন চুপ্পুের সঙ্গে একমত? মন্তব্য জানান, নীচের ঘরে৷