সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা ‘সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে তার আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আদালতের কাছে জমা দেন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর প্রধান রঞ্জিত সিনহার সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাতপ্রার্থীদের নামের একটি রেজিস্টার৷ ঐ রেজিস্টার কে দিয়েছে বা কীভাবে পেয়েছে তার পরিচয় বা সূত্র জানাতে অস্বীকার করেন তিনি৷ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই ইদানীং দেশের দুটি বড় কেলেঙ্কারি – টুজি স্পেকট্রাম এবং কয়লা খনি দুর্নীতির তদন্তে রয়েছে৷ সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিনহার সরকারি বাসভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতপ্রার্থীদের মধ্যে ঐ দুই মামলার অভিযুক্তসহ ঐ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু বিতর্কিত ব্যক্তির নাম রয়েছে ঐ রেজিস্টারে৷ সিবিআই প্রধানের সঙ্গে ঐ সব বিতর্কিত ব্যক্তিদের সাক্ষাতের একটাই কারণ থাকতে পারে, তা হলো মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া৷
শীর্ষ আদালত ঐ রেজিস্টার পাওয়ার সূত্র জানাতে বললে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ ঐ ব্যক্তির নাম প্রকাশে অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন৷ কারণ তাহলে ঐ ব্যক্তির প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকে যায়৷ তবে রেজিস্টারে থাকা নাম ও তথ্য সত্য কিনা তা সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিনহার বাড়ির রক্ষীদের জেরা করে জানা যেতে পারে৷ ব্যক্তির পরিচয় গোপন রেখেই শুনানি চালানোর আর্জি জানানো হয়৷ বলা হয়, এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে যেখানে খোদ সিবিআই তদন্তের স্বার্থে গোপন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা চালিয়ে গেছে৷ সিবিআই প্রধানের আইনজীবী অবশ্য তার বিরোধীতা করে বলেন, ঐ ব্যক্তির নাম না জানালে শুনানি চলতে পারে না৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
আদালতের পূর্বেকার আদেশ পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানিয়ে ঐ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে নতুন হলফনামা দায়ের করে বলা হয়, সারা বিশ্বে যখন সরকারি, বেসরকারি কিংবা জনজীবনের দুর্নীতি ফাঁসকারী বা ঐ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী, যাকে বলা হচ্ছে ‘হুইসেল-ব্লোয়ার', তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে দুর্নীতির মোকাবিলায়, তখন সেখানে একটি এনজিওকে সরকারি মহলের দুর্নীতির তথ্য-প্রদানকারীর নাম প্রকাশ করতে বাধ্য করা অনুচিত হবে৷
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ কর্তৃপক্ষের কর্মী সত্যেন্দ্র দুবে স্বর্ণ চতুর্ভুজ মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণ কাজে ব্যাপক দুর্নীতির কথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন৷ পরিণামে মাফিয়াদের হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়৷ এখানেই শেষ নয়, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার সন্মুগন মঞ্জুনাথ পেট্রোল পাম্পে ভেজাল তেল বিক্রি হাতে নাতে ধরে ঐ পেট্রোল পাম্প ‘সিল' করে দেন এবং পেট্রোল পাম্প বণ্টনকারী সংস্থার দুর্নীতি ফাঁস করে দেন৷ তাঁকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়৷ কারণ তখন দেশে দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য প্রদানকারীর নিরাপত্তার কোনো আইনি ব্যবস্থা ছিল না৷
জনমনে তীব্র ক্ষোভের দিকে তাকিয়ে সরকার ২০১৪ সালের মে মাসে পাশ করেন ‘হুইসেল-ব্লোয়ার প্রোটেকশন' আইন৷ জনজীবনের দুর্নীতি ফাঁস করতে জনগণই যাতে এগিয়ে আসে নির্ভয়ে৷ ঐ আইনে আছে দুর্নীতির তথ্য দিলে তাঁর নাম বা পরিচয় গোপন রাখা হবে তাঁর নিরাপত্তার জন্য৷ তবে কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য দেন, তাহলে দু'বছর পর্যন্ত জেল এবং ৩০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে৷ হুইসেল-ব্লোয়ারদের কঠোর নিরাপত্তা সুনিশ্চত করা না হলে সরকার কিংবা কর্পোরেট জগতের দুর্নীতি দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচতে দেবে না৷