দুর্নীতি বন্ধে দুদকের অভিযান কতটা কার্যকর?
১০ জানুয়ারি ২০২০সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম. হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতায় দুর্নীতি হয়৷ একপক্ষ রাজনীতিবিদ, আরেক পক্ষ সরকারি কর্মচারী আর তৃতীয় পক্ষ ব্যবসায়ী বা ঠিকাদার৷ এখন কোন একজনকে গ্রেপ্তার করলেই দুর্নীতি কমবে না৷ আগে বন্ধ করতে হবে রাজনীতিকদের দুর্নীতি৷’’
দিনাজপুরের পার্বতীপুরে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাগে এক কোটি ৮৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে৷ এই টাকার বৈধ কোন উৎস দেখাতে না পারায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তার বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা করা হয়েছে৷ অজ্ঞাত ব্যক্তির টেলিফোন পেয়েই এই অভিযান চালায় দুদক৷
হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘‘এই কর্মকর্তার মতো আরো অনেক সরকারি কর্মকর্তা আছেন যারা কমিশন ছাড়া কাজ ছাড়েন না৷ এখন একজন তাজুল ইসলামকে ধরলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না৷ সব পক্ষের বিরুদ্ধেই একযোগে কাজ করতে হবে৷ এমনকি রাজনৈতিক দুর্নীতিও বন্ধ করতে হবে৷ মানুষ ভোট দিতে না পারাও এক ধরনের দুর্নীতি৷ রাজনীতিবিদদের কারণে অন্যরা সুযোগ নিচ্ছেন৷’’
একই দিনে খুলনায় দুদক ফাঁদ পেতে একজন খাদ্য কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে৷ ডুমুরিয়া উপজেলার আঠারোমাইল বাজার এলাকার জামান অটো রাইসমিলের মালিক মো. কামরুজ্জামানের ১১ লাখ টাকার একটি বিল প্রদানের ক্ষেত্রে খাদ্য কর্মকর্তা ইলিয়াস হোসেন গড়িমসি ও তালবাহানা করছিলেন৷ এক পর্যায়ে বিলটি ছেড়ে দিতে ইলিয়াস হোসেন তার কাছে এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন৷ বিষয়টি রাইসমিল মালিক দুদককে জানান৷ সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার কামরুজ্জামান খাদ্য কর্মকর্তা ইলিয়াস হোসেনকে একটি খামে করে ১ লাখ টাকা দেন৷ এ সময় খাদ্যগুদামের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুদক কর্মকর্তারা ইলিয়াস হোসেনের অফিসে হানা দিয়ে তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ১ লাখ টাকাসহ তাকে গ্রেপ্তার করে৷
দুদকের এই ধরনের কার্যক্রমে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে?
জবাবে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একদিনে তো দুর্নীতির এই অবস্থা তৈরি হয়নি৷ এটা একদিনে যাবেও না৷ তবে দুদক যে কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে কিছু ইতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে৷ তবে শুধু দুদকের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে সুশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জরুরি৷’’
দুদকের সাবেক কমিশনার শাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পুও ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন, ‘‘দুদকের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে৷ বিশেষ করে সরকার প্রধানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি এই কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎসাহ জোগাবে৷ তবে দুদকের একার পক্ষে বা একশটা দুদক দিয়েও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না, যদি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা না যায়৷’’
গত বছরের জানুয়ারিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে ঢাকায় দুর্নীতির ধারণা সূচক সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়৷ সেখানে দেখা যায় ১৩তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ৷ টিআইর দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তালিকার এক নম্বরে ছিল৷ অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল৷ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে দ্বাদশ, ২০১১ সালে ১৩তম , ২০১২ সালে ১৩তম , ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৪ সালে ১৪তম, ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১৬ সালে ১৫তম, ২০১৭ সালে ১৭তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম৷ ২০১৯ সালের রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি৷ আর গত জুনে দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে দেশে দুর্নীতির অভিযোগ বেড়েছে৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে দুর্নীতি কমেছে এটা বলা মুশকিল৷ বরং দুর্নীতির গভীরতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে৷ সরকার প্রধানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে৷ তবে দিনাজপুর বা খুলনার ঘটনাগুলো তো একদিনে তৈরি হয়নি৷ সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব৷’’