‘দুর্নীতি বন্ধে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন'
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
ডয়চে ভেলে : আপনারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে যতটা স্বাধীন করতে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সরকারের কাছে এতটা আন্তরিকতা কি আশা করা সম্ভব?
ড. ইফতেখারুজ্জামান : স্বাভাবিক অবস্থায় এটা আশা করা যায় কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। এখনো সেই প্রশ্নটা আছে বলেই আপনি প্রশ্নটা করলেন। এখন আমরা একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আছি। অনেক রক্তের বিনিময়ে এই অর্জন। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বের এই আন্দোলনে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এর অংশীদার বলে নিজেরা দাবি করছেন। যৌক্তিকভাবেই হয়তোবা। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন লাগবে। এটা যদি হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে প্রত্যাশায় জায়গায় যাওয়া সম্ভব। এই শর্তে যে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতবাচক পরিবর্তন আসতে হবে। যে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অবস্থান ছিল, সেই কর্তৃত্ববাদ বিকাশের অন্যতম স্তম্ভ ছিল দুর্নীতি। এই দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামো দখল করা হয়েছিল। এটার জন্যই তো সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো শামিল, ফলে তাদের কাছ থেকে তো ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করাই যায়, যদিও এটার লক্ষণ আমরা দেখিনি। ৫ আগস্ট থেকে দলবাজি, দখলবাজি একইভাবে হয়েছে। এখানে একটা ব্যানারের পরিবর্তন হয়েছে, চর্চাটা এখনো রয়ে গেছে।
বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে বলেছেন, সেটা কিভাবে সম্ভব?
আমরা তো এটার জন্য আইন পরিবর্তন করতে বলেছি। আমরা কর্তৃত্ববাদের সময়ও দেখেছি, অন্য সময়ও দেখেছি এবং অন্যান্য দেশেও যেটা হয়, সরকারি খাতে যে দুর্নীতি, সেটা এককভাবে সরকারি পর্যায় থেকে হয় না। সরকারি লোকজন, আমলাদের পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আসে বেসরকারি মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত। সেখানে ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী হিসেবে, সরবরাহকারী হিসেবে এতে তাদের ভুমিকা থাকে। এই অবস্থা থেকে যদি আমরা বের হতে চাই তাহলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকেও বের করতে হবে। সেই লক্ষেই এই সুপারিশটা করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানা খাতের দুর্নীতিকে অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
দুর্নীতি বন্ধে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে একটা পরিবর্তনের কথা আপনারা বলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কি এটা করা সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করাও সম্ভব। আমাদের সুপারিশের মধ্যে অনেক কিছুই আছে, যা আশু করণীয়। সেগুলো আমরা চিহ্নিত করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছি। এর মধ্যে আছে বেশ কিছু আইনি সংস্কার, নতুন কিছু আইনের দরকার, বেসরকারি খাতের দুর্নীতির বিষয়টি আছে, এর বাইরেও কিছু আইনি সংস্কারের দরকার আছে। বর্তমান সরকারের আমলেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব, যা পরবর্তীতে সংসদে অনুমোদিত হওয়ার চর্চা আছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসা খাত, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতি এই ত্রিপক্ষীয় আতাতের উপর ভিত্তি করে যে দুর্নীতি, সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা বেশ কিছু সুপারশি করেছি। এগুলো দুদকে সরাসরি সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এতে কাজেও গতি আসবে। দুদকের স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছি। দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্যও আমরা সুপাশি করেছি। এগুলো এখনই করা সম্ভব। কাঠামোটাকে তৈরী করে যদি ধরে রাখা হয় তাহলে নির্বাচন পরবর্তীতে কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তদন্তের আগে আপনারা অনুসন্ধান বন্ধ করতে বলেছেন। কিন্তু অনুসন্ধান করা না হলে কিভাবে জানা যাবে একজন মানুষ কি পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন?
আমরা তদন্ত না করতে বলিনি। আমরা বলেছি, তদন্তের আগে অনুসন্ধান করা বাধ্যতামূলক করা আছে। সেটা বন্ধ করতে বলেছি। ক্রিমিনাল অপরাধের ক্ষেত্রে কিন্তু অনুসন্ধান পর্যায়ে থাকে না। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রথমত, এটা করা হয়েছে, দীর্ঘসূত্রতার জন্য। দ্বিতীয়ত, এটার জন্য যে সময় নেওয়া হয়, তাতে যার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হচ্ছে, তিনি যদি প্রভাবশালী হন, তাহলে তিনি তথ্য সরিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পান। আমরা এটা বন্ধ করতে বলেছি। পাশাপাশি এটার কারণে দুদকের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই কারণে আমরা আন্তর্জাতিক চর্চাটা এখানে করতে বলেছি।
উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বন্ধে যে টাস্ক ফোর্সের কথা আপনারা বলেছেন, এটা কাদের নিয়ে গঠিত হবে?
এখানে আমরা চিহ্নিত করেছি, বিশেষ করে বিদেশে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে দুই ধরনের টাস্কফোর্সের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে বিভিন্ন দেশের চর্চা অনুযায়ী, দুদকের পাশাপাশি এনবিআর, বিএফআইইউ, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, সিআইডিকে আমরা যুক্ত করতে বলেছি। দুদকের একার পক্ষের সবসময় আইনগতভাবেই এসবের অনুসন্ধান করা সম্ভব হয় না। সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজটা করলে প্রক্রিয়াটা সহজ হয়। টাস্কফোর্স সমন্বয়টা নিশ্চিত করবে।
ব্যক্তি স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধের সুপারিশ আপনারা করেছেন। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক মহলের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্মতিতেই তো কাজগুলো হয়। তাহলে এটা বন্ধ হবে কিভাবে?
আপনার প্রশ্নের মধ্যে জবাব আছে। যেহেতু উচ্চ পর্যায়ে অংশগ্রহণ বা নির্দেশে কাজগুলো হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য সাংবিধানিক অঙ্গিকারের কথা আমরা বলেছি। সংবিধানে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক বলে আমরা মনে করি। আমাদের বর্তমান সংবিধানেও এটা বলা আছে। আমরা এর সঙ্গে একটু যুক্ত করতে বলেছি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আপনাদের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন?
বর্তমান সরকারের সময় যে উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে, এটা কিন্তু শুধু অন্তবর্তী সরকারের এজেন্ডা না। এটা কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার জায়গা। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মূল চেতনার জায়গা হলো, বাংলাদেশে দুর্নীতির যে গভীর বিস্তৃতি রয়েছে, সেটা দেশবাসী আর দেখতে চায় না। এটা যেহেতু সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এবং আমরা মনে করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়। তাই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, কিন্তু চ্যালেঞ্জ থাকবে।