ফিফা-র খোলনলচে বদলে যাচ্ছে৷ সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন ফিফার সদস্যরা৷ আশা করা হচ্ছে, অনুমোদিত প্রস্তাবগুলো কার্যকর হলে ফিফায় দুর্নীতির পথ রুদ্ধ হবে৷
ছবি: Reuters/R. Sprich
বিজ্ঞাপন
১৭৭ জন সদস্যের ভোটে অনুমোদিত হয়েছে দুর্নীতিরোধকল্পে তোলা বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব৷ ২২ জনের বিরোধিতা এবং ৬ জনের ভোটদানে বিরত থাকা এসব সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি৷
সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মূল উদ্দেশ্য ফিফা-কে দুর্নীতিমুক্ত করে কলঙ্কমুক্ত করা৷ ২০১৫ সালের মে মাসে সুইজারল্যান্ডের জুরিখেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ৭ ফিফা কর্মকর্তা৷ সুইজারল্যান্ডের পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে৷ প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ব্যাপক এবং সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ সেই গ্রেপ্তার পর্বের পর থেকে কলঙ্কে আকণ্ঠ ডুবে গেছে ফিফা৷ সাবেক ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটারকে ৬ বছরের জন্য ফুটবলে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে কলঙ্কের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে৷
ব্লাটার থাকতে ফিফার যত কেলেঙ্কারি
গত ১৭ বছর ধরে ফিফার নেতৃত্বে আছেন সেপ ব্লাটার৷ তার এই মেয়াদকালে ফিফা বেশ কয়েকবার কেলেঙ্কারির মুখে পড়েছে৷ এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
১৯৯৭: বিশ্বকাপ বিপণন চুক্তি থেকে ঘুস
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগেই এক ঘুস কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেপ ব্লাটার৷ তাঁর আগের প্রেসিডেন্ট জোয়াও আভেলাঞ্জ এবং তাঁর সাবেক জামাতা রিকার্ডো টেশেরার সঙ্গে বিশ্বকাপের বিপণন সত্ত্ব সংক্রান্ত এক ঘুস কেলেঙ্কারিতে ব্লাটারের নামও এসেছিল৷ সেসময় ফিফার মহাসচিব ছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১৯৯৮: আফ্রিকার প্রতিনিধিদের ঘুস
ফ্রান্সের বিশ্বকাপ শুরুর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সেপ ব্লাটার৷ অভিযোগ আছে, সেসময় প্যারিস হোটেলে অবস্থানরত আফ্রিকার প্রত্যেক প্রতিনিধিকে পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার করে ঘুস দেয়া হয়েছিল৷ ব্লাটার অবশ্য এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন৷
ছবি: AP
২০০৬: টিকিট বিক্রির দায়িত্বে ভাইস প্রেসিডেন্ট
২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার সুযোগ পায় ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো৷ সেদেশের জ্যাক ওয়ার্নার তখন ফিফার ভাইস প্রেসিডেন্ট৷ তার পরিবারের সদস্যরা সেবার সেদেশে টিকিট বিক্রির সুযোগ পায় এবং নয় লাখ মার্কিন ডলারের মতো কমিশন থেকে আয় করে, যা আসলে অনুচিত৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Acosta
২০১০: রাশিয়া এবং কাতারে বিশ্বকাপ
২০১৮ এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে রাশিয়া এবং কাতারকে দেয়া হয়৷ কিন্তু এই ঘোষণার আগেই ফিফার দুই কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা হয়৷ রাশিয়া এবং কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেয়া নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
২০১১: ব্লাটারের প্রতিদ্বন্দ্বীর পদত্যাগ
সেবছর ফিফার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ব্লাটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন কাতারের মোহাম্মেদ বিন হাম্মাম৷ কিন্তু ভোটাভুটির আগেই ক্যারাবিয়ানরা হাম্মামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনেন৷ ফলে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন হাম্মাম৷
ছবি: Saeed Khan/AFP/Getty Images
২০১৪: টিকিট বিক্রিতে দুর্নীতি
ব্রাজিলে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিশ্বকাপের টিকিট বিতরনে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় আর্জেন্টিনার ফিফা কর্মকর্তা জুলিও গ্রোডোনার বিপক্ষে৷ ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই মারা যান তিনি৷
ছবি: Juan Mabromata/AFP/Getty Images
২০১৫: ব্যাপক ধরপাকড়
দুর্নীতির অভিযোগে ২৬ মে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯ ফিফা কর্মকর্তাসহ ১৪ জন৷ ফিফা সভাপতি নির্বাচনের ঠিক আগে গ্রেপ্তার হলেন তাঁরা৷ এ কেলেঙ্কারির পর ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি উঠলেও সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/epa
7 ছবি1 | 7
শুক্রবারের সম্মেলনে সভাপতি থেকে শুরু করে ফিফার উচ্চ পদস্থ প্রায় সব কর্মকর্তারই ক্ষমতা এবং কর্মপদ্ধতির পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়৷ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সেগুলো অনুমোদিত হয়েছে৷ অনুমোদিত প্রস্তাবগুলোর একটিতে বলা হয়েছে, আগামীতে ফিফা সভাপতি একজন কর্পোরেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতো ভূমিকা পালন করবেন৷ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তাঁর কর্তৃত্ব কমবে, মূল কাজই হবে সংস্থার কর্মকৌশল সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়া৷
ফিফার নির্বাহী পরিষদও দুর্নীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছিল৷ সেখানেও আসছে পরিবর্তন৷ ফিফা নির্বাহী কমিটি আগামীতে কাজ করবে ‘ফিফা কাউন্সিল' নামে৷ কর্পোরেট বোর্ডের পরিচালকরা যেমন সীমিত গণ্ডির মধ্যে তাঁদের ক্ষমতা চর্চা করেন, সেভাবেই কাজ করবেন ফিফা কাউন্সিলের কর্মকর্তারা৷ এছাড়া ফিফার মহাসচিব আগামীতে বিশ্ব ফুটবলের সিইও হিসেবে কাজ করবেন৷
ব্লাটারের জীবনের গল্প
সেপ ব্লাটার কীভাবে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার সর্বোচ্চ পদ পেয়েছিলেন? থাকলেন কীভাবে এত বছর? ছবিঘরে থাকছে সেই গল্প৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Yusni
অবশেষে মসনদ ছাড়লেন...
বিতর্কিত নির্বাচনে আবার জয়ী হবার চারদিন পরই ফিফা সভাপতির পদ ছাড়লেন সেপ ব্লাটার৷ সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন টানা ১৭ বছর৷ পদত্যাগের পর তিনি আর ফুটবলের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া সাবেক ফিফা অধিপতি নন, তার চেয়ে বড় এখন ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শিরোমনির ভাবমূর্তি৷ যদিও ব্লাটার শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, তিনি নিজে কোনোদিন কোনো দুর্নীতি করেননি৷
ছবি: Reuters/A. Wiegmann
বর্ণময় কেরিয়ার
১৯৭৫ থেকে ২০১৫ – ৪০ বছর ব্লাটার ছিলেন ফিফার সঙ্গে৷ ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যোগ দেয়ার আগেও বড় দায়িত্বেই ছিলেন৷ সুইস আইস হকি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন, সুইস স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে৷ ফিফায় কাজ শুরুর আগে আডিডাস-এর কর্ণধার আডল্ফ ডাসলারের একটি ঘড়ি কোম্পানির জনসংযোগ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বেও দেখা গেছে তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Weißbrod
যেভাবে মসনদে....
ফিফায় প্রথম উল্লেখযোগ্য পদ পেয়েছিলেন ১৯৮১ সালে৷ সেবার জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ব্লাটার৷ শীর্ষে উঠতে লেগেছে ১৭ বছর৷ তখন ফিফা সভাপতি ছিলেন জোয়াও আভেলাঞ্জ৷ ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে তখনকার উয়েফা প্রেসিডেন্ট লেনার্ট ইয়োহানসনকে হারিয়ে ব্লাটার হয়ে যান ফিফা সভাপতি৷ তখনই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে৷ ভোট কিনে জয়ী হবার অভিযোগটাকে ব্লাটার তখন পাত্তাই দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
বিশাল ক্ষতি
ফিফা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাওয়ার এক বছর পরই ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তখনকার জেনারেল সেক্রেটারি মিশেল জেন-রুফিনেন৷ সেবার বিপননে ফিফার ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়৷ সেই ক্ষতির জন্য ব্লাটারের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন রুফিনেন৷ তদন্তের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত ব্লাটার তা হতে দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Bally
জার্মানিকে ‘উপহার’!
২০০০ সালের বিশ্বকাপ হয়েছিল জার্মানিতে৷ ধারণা করা হয়, জার্মানির আয়োজক হওয়ার পিছনে ব্লাটারের খুব বড় ভূমিকা ছিল৷ ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো সভাপতির পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেন ব্লাটার৷ নির্বাচনে জিততে কোনো অসুবিধা হয়নি তাঁর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Limina
প্রতিপক্ষ ঘায়েল
২০১১ সালে এক সময়ের ‘ব্লাটারের লোক’ মোহাম্মদ বিন হাম্মাম দাঁড়িয়ে যান ব্লাটারের বিপক্ষে৷ কাতারের এই ফুটবল সংগঠক কিন্তু নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে সভাপতি হতে পারেননি৷ মধ্যপ্রাচ্যের ভোট কেনার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে৷ বাধ্য হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাঁকে৷ পরে তাঁকে ফুটবল থেকে আজীবন নিষিদ্ধও করে ফিফা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Yusni
বেকেনবাউয়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং...
২০১৪ সালে জার্মান ফুটবল কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারকে বহিষ্কার করে ফিফা৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, জার্মানির জন্য ২০০০ বিশ্বকাপে আয়োজক হওয়ার অধিকার তিনি ব্লাটারের কাছ থেকে কিনেছেন৷ একটা সময় পর্যন্ত দু’জনের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ এখন বেকেনবাউয়ার অকপটেই স্বীকার করেন, সেই সুসম্পর্কের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Weissbrod
ব্লাটার এবং ম্যান্ডেলা
কেরিয়ারে সবসময়ই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা সব পর্যায়ের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন ব্লাটার৷ জাতিসংঘের মহাপরিচালক, বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, এমনকি পোপ-এর সঙ্গেও তাঁর ভালো সম্পর্ক৷ ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর৷ ম্যান্ডেলাকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজক করতে যথাসাধ্য করবেন৷ কথা রেখেছিলেন ব্লাটার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/E. Risch
ব্লাটার যিশু বা মাদার টেরেসার মতো!
ব্লাটার কিন্তু সর্বত্র নিন্দিত বা সমালোচিত নন৷ চিরকাল ক্ষমতা উপভোগ করেছেন৷ ঘুরতে ভালোবাসেন৷ রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে সফর করেছেন প্রায় গোটা বিশ্ব৷ কোনো কোনো অঞ্চলে ভীষণ শ্রদ্ধার পাত্র তিনি৷ আফ্রিকা এবং এশিয়া অঞ্চলে ফুটবলের উন্নয়নের জন্য প্রচুর অনুদান দিয়েছেন তিনি৷ ওই দুই অঞ্চলের ফুটবল কর্তাদের কাছে তাই তিনি যিশু বা মাদার টেরেসার মতো শ্রদ্ধেয়৷