বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে কি পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি টেলিস্কোপ কক্ষপথ থেকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে৷ দূরের গ্রহগুলি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করছে এই অভিযান৷
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর বুকে টেলিস্কোপ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে৷ কোনো গ্রহ সেটির নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করার সময় গ্রহের অভিকর্ষ নক্ষত্রকে আকর্ষণ করে৷ তখন নক্ষত্র কিছুটা নড়াচড়া করে৷ তথাকথিত এই রেডিয়াল মুভমেন্টের মাধ্যমে এক্সোপ্ল্যানেটের ভর পরিমাপ করা যায়৷ জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের
দিদিয়ে কোয়েলস বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, ‘‘দুই পদ্ধতির মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব৷ নক্ষত্রের সামনে দিয়ে গ্রহ চলে যাবার সময় কিছু প্রণালী রেডিওভেলোসিটিও পরিমাপ করে৷ সে ক্ষেত্রে ভর ও আয়তন জানা যায়৷ তারপর তার ভিত্তিতে ঘনত্ব হিসেব করতে হয়৷ এভাবে গ্রহের চরিত্র সম্পর্কে জানা যায়৷''
দূরের এই সব মহাজাগতিক বস্তু কি বৃহস্পতি গ্রহের মতো গ্যাস দিয়ে তৈরি? নাকি পৃথিবী বা মঙ্গলগ্রহের মতো পাথর দিয়ে তৈরি? এই সব গ্রহ কি শুধু মহাসাগর বা বরফের চাদরে ঢাকা? এমন সব তথ্য জানতে পারলে বোঝা যাবে, কোনো গ্রহ বাসযোগ্য হতে পারে কিনা৷
দূরের গ্রহগুলির নিজস্ব বায়ুমণ্ডল রয়েছে কিনা, স্যাটেলাইট সেই তথ্যও জানার চেষ্টা করছে৷ সেটা জানতে নক্ষত্রের কাছে গ্রহের কক্ষপথ ও গ্রহের উপর নক্ষত্রের আলোকপাত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে৷ দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷
চার দশক ধরে মহাকাশে ঘুরছে যারা
আমাদের মহাকাশ চষে বেড়াতে ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট যাত্রা শুরু করেছিল মহাকাশযান ভয়েজার ২৷ সেই যাত্রার ষোল দিন পর ভয়েজার ১-ও মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে৷ এখনও সক্রিয় আছে যান দু’টি, পাঠাচ্ছে নানা খবর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA JPL
দুই বোনের অনুসন্ধান
১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট ভয়েজার ২ মহাকাশযানকে মহাকাশে পাঠায় নাসা৷ সেটির যাত্রা এখনো চলছে৷ সেবছরেরই পাঁচ সেপ্টেম্বর ভয়েজার ১ একইভাবে মহাকাশে যাত্রা করে৷ এই দুই মহাকাশযানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বৃহস্পতি এবং শনিগ্রহণ সম্পর্কে যতটা সম্ভব্য তথ্য সংগ্রহ করা৷ তাদের যাত্রার শুরুর সময় অবধি গ্রহ দু’টো সম্পর্কে তেমন একটা জানা যায়নি৷ মহাকাশযান দু’টোতে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার উপযোগী প্লুটোনিয়াম ব্যাটারি রয়েছে৷
ছবি: REUTERS/NASA/JPL-Caltech
এখনও তথ্য পাঠাচ্ছে তারা
পৃথিবীতে একেকটি ভয়েজারের ওজন ছিল ৮২৫ কেজি করে৷ নাসা এখন অবধি মহাকাশকেন্দ্রিক যে সব সাফল্য অর্জন করেছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ভয়েজার অভিযান৷ সে দু’টি এখনো মহাকাশ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাঠাচ্ছে৷ পৃথিবী থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া যন্ত্র দু’টির সঙ্গে ২০৩০ সাল অবধি রেডিও যোগাযোগ অব্যাহত রাখার আশা করছে নাসা৷
ছবি: public domain
সৌরজগতের সীমানার বাইরে
২০১২ সালের ২৫ আগস্ট ভয়েজার ১ আমাদের সৌরজগতের একটি সীমানা ‘হিলিওপস’ অতিক্রম করে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে পৌঁছে গেছে৷ এটি হচ্ছে মানুষের তৈরি একমাত্র যন্ত্র যা পৃথিবী থেকে বর্তমানে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এগিয়ে যাচ্ছে ভয়েজার ২-ও
ভয়েজার ১-এর মতো ভয়েজার ২-ও সৌরজগতের একটি সীমানার বাইরে চলে গেছে৷ ২০১৮ সালের পাঁচ নভেম্বর এই যানটি ‘ইন্টার্স্টেলার স্পেসে’ প্রবেশ করে৷ এই যানে পাঠানো তথ্য অতীতের বিভিন্ন ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Jet Propulsion Lab via AP/dpa
‘স্পেস বাবল’-এর কিনারে
সৌরজগতের বিভিন্ন সীমানা রয়েছে৷ প্রথমটি হচ্ছে ‘টার্মিনেশন শক৷’ সেখানে সৌর বাতাস নাটকীয়ভাবে কমে যায়৷ ‘হিলিওস্পেয়ার’ এর পরে ‘হিলিওপস’ এর অবস্থান৷ আর এটি হচ্ছে ‘স্পেস বাবল’ এর কিনারা যেখানে সৌর শিখা ‘ইন্টারস্টেলার’ রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে৷ এখন অবধি ধারণা ছিল যে বাতাস ক্রমশ কমতে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA JPL
তবে, বোনরা জানাচ্ছে অন্য তথ্য
তবে দুই মহাকাশযানের তুলনামূলক পরিমাপ আমাদের জানাচ্ছে যে আমাদের সৌরজগতের অভ্যন্তরে একটি স্পষ্ট সীমান্ত রয়েছে৷ ‘ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম’-এর তাপমাত্রাও আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/Nasa
সব দিক থেকে বৃহস্পতিগ্রহ
‘ইন্টারস্টেলার’ বিষয়ক নানা উদ্ঘাটন ছাড়াও মহাকাশযান দু’টি আরো অনেক বিষয়ে তথ্য জানিয়েছে৷ ১৯৭৯ সালের পহেলা জানুয়ারি বৃহস্পতি গ্রহের ছবি পাঠায় ভয়েজার ১৷ যানটি গ্রহটি এবং সেটির চার চাঁদের মোট ১৭,৪৭৭টি ছবি পাঠিয়েছে৷ বৃহস্পতি গ্রহের চারপাশ ঘিরে যে পাতলা বৃত্ত রয়েছে, তার অস্তিত্ব এই ছবির মাধ্যমেই আমরা জেনেছি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
সেকেন্ডে ১৬ কিলোমিটার গতি
বৃহস্পতিগ্রহ পার হওয়ার পর ভয়েজার ১ সেকেন্ডে ১৬ কিলোমিটার গতিতে পৌঁছায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
শনিগ্রহের শুরু, সম্ভবত
ভয়েজার ২ শনি গ্রহের এই রঙ্গিন ছবিটি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে৷ ১৯৮১ সালে মহাকাশযানটি আমাদের সৌরশক্তির ষষ্ঠ গ্রহের কাছে পৌঁছায়৷ শনি গ্রহের ২১ মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে এই ছবিটি তোলা হয়েছে৷
ছবি: HO/AFP/Getty Images
সবকিছু নিয়ন্ত্রণে
মহাকাশযান দু’টিকে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডিনা শহরের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের এই ছবিটি ১৯৮০ সালে তোলা৷ বর্তমানে অবশ্য নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র অনেক আধুনিক করা হয়েছে৷
ছবি: NASA/Hulton Archive/Getty Images
এলিয়েনদের জন্য পৃথিবীর শব্দ
মহাকাশযান দু’টি যদি তাদের অন্তহীন যাত্রাপথে কোন প্রাণের সন্ধান পায়, তাহলে সেটিকে পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম হবে৷ যান দু’টিতে রয়েছে এরকম কিছু উজ্জ্বল সোনালি ডিস্ক, যাতে পৃথিবীর ছবি এবং মানুষ, জীবজন্তু এ প্রকৃতির শব্দ রেকর্ড করা রয়েছে৷ এমনকি এগুলো বাজানোর ব্যবস্থাও রয়েছে ভয়েজার দু’টিতে৷
ছবি: NASA/Hulton Archive/Getty Images
11 ছবি1 | 11
আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলি যে সেগুলির বর্তমান অবস্থানে জন্মগ্রহণ করে নি, তা ইতোমধ্যেই জানা গেছে৷ প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী বিশাল মেঘের পুঞ্জ ঘনীভূত হলে এবং ঘূর্ণায়মান চাকতি সদ্য সৃষ্টি হওয়া নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করলে গ্রহ সৃষ্টি হয়৷
সূর্য থেকে অনেক দূরে বৃহস্পতির মতো বিশালাকার গ্যাসভিত্তিক গ্রহ সৃষ্টি হয়েছে৷ চারিপাশের পরিবেশের কারণে থমকে গেলে এমন গ্রহ সূর্যের আরও কাছে এগিয়ে যায়৷ ভিতরের অংশে, যেখানে ধূলিকণা ঘনীভূত হয়ে পাথুরে কাঠামোয় পরিণত হয় – গ্রহ সেদিকে ধাবিত হয়৷ বিকাশের সময় গ্রহগুলি অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে৷ কিয়প্স স্যাটেলাইট সেই গতিপথ চিহ্নিত করতেও যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করবে৷
এই স্যাটেলাইট এমনকি নতুন জগতও আবিষ্কার করতে পারে৷ হয়তো এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটের তুলনায় ছোট গ্রহের অস্তিত্বের কথাও জানা যাবে৷ পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডলে ঢাকা পাথুরে গ্রহও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
আগামী দশকগুলিতে একাধিক সুপার টেলিস্কোপ এমন সব দূরের গ্রহগুলি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণা চালাবে৷ তখন হয়তো মানবজাতির অন্যতম মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের আভাস পাওয়া যাবে৷
পৃথিবীর বাইরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো প্রান্তে কি প্রাণের স্পন্দন রয়েছে?