বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ৷ শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা৷ দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের এক কর্মশালায় প্রকাশিত সমীক্ষার ভিত্তিতে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, ঢাকার ৫৯টি এলাকায় মাটি ও পানিতে সীসার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি৷ ঢাকা শহরের ৬ লাখ মানুষ এখন সিসা দূষণের কবলে৷
ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার৷ ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ু দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷ ইট ভাটাগুলো বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ বায়ু দুষণের জন্য ইটভাটা ৩৪ ভাগ এবং মোটরযান ১৮ ভাগ দায়ী৷
ঢাকার বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
03:48
‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে৷ ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে৷ ফলে খাল ও নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে৷
৭১৯টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস৷ এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন৷ ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে ১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে৷
ঢাকার পাশাপাশি ছোট জেলা শহরগুলোতে জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ চলছে৷ ২০১৭ সালের বর্ষা মৌসুমে ঢাকায় টিকে থাকা ১৩টি খালের মধ্যে মাত্র দুটি সচল ছিল৷
তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখেছে: ড. আব্দুল মতিন
This browser does not support the audio element.
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রধান ড. আব্দুল মতিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে৷ যার ফল স্বাস্থ্য বিপর্যয়৷ আমরা অনেক দিন ধরেই পরিবেশ নিয়ে কথা বলছি৷ কিন্তু সমস্যা হলো যারা পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী তারা অনেক ক্ষমতাধর৷ তাদের এই ক্ষমতা রাজনৈতিকও৷ ফলে তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখেছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, নীতিমালা আছে৷ কিন্তু তা মানা হচ্ছেনা৷ এসব আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করলে শাস্তিরও বিধান আছে, কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছেনা৷ কিন্তু সরকার চাইলে পারে৷ সরকারের সদিচ্ছাই পারে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে৷ কিন্তু সরকার যদি সুশীল সমাজের মত শুধু কথা বলে, কাজ না করে তাহলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে৷’’
ঢাকায় পানি ও বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র লোক ও শিশুরা৷ রাজধানীর ৫৯টি এলাকাকে তীব্র মাত্রায় সিসা-আক্রান্ত বা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এসব এলাকার পানি ও মাটিতে আরও পাওয়া গেছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫), কীটনাশক ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তু৷
শব্দ দূষণ শিশুদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে: ডা. শাহরিয়ার
This browser does not support the audio element.
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে শুধু সিসা-দূষণের শিকার ছয় লাখ মানুষ৷ তাদের বেশিরভাগই শিশু৷ রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে সিসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্রার চেয়েও বেশি৷
সোহরাওয়ার্দি হাসপতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিবেশ দূষণের প্রধান শিকার নারী ও শিশু৷ বিশেষ করে শব্দ দূষণ শিশুদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে৷ তারা বধিরতায় আক্রান্ত হয়৷ তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়৷ তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে উঠতে পারে৷ আর অতিরিক্ত সিসা শিশুদের রক্তশূণ্যতা সৃষ্টি করে৷ তারা ঠিকমত খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...
পানির নয়, যেন প্লাস্টিকের নদী
বিশ্বের সাগরগুলিতে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, তার অধিকাংশই আসে এশিয়ার আটটি ও আফ্রিকার দু’টি নদী থেকে৷ এসব নদীর অপরাপর পরিবেশগত সমস্যাও কম নয়৷
ছবি: Imago/Xinhua/Guo Chen
১) ইয়াংৎসে নদী
ইয়াংৎসে হলো এশিয়ার দীর্ঘতম ও বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী৷ সাগরে প্লাস্টিক বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও দৃশ্যত ইয়াংৎসে সবার ওপরে – অন্তত সাম্প্রতিক একটি জরিপ তাই বলছে৷ ইয়াংৎসে শাংহাইয়ের কাছে পূর্ব চীন সাগরে গিয়ে পড়ে৷ চীনের অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য এই নদীটির গুরুত্ব অসীম৷ ইয়াংৎসের উপকূলে ৪৮ কোটি মানুষের বাস, যা কিনা চীনের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ৷
ছবি: Imago/VCG
২) সিন্ধু নদ
জার্মানির হেল্মহলৎস পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের সমীক্ষা অনুযায়ী, সাগরে যে প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, তার ৯০ শতাংশ আসে বিশ্বের ১০টি নদী থেকে৷ সিন্ধু নদ বা ইন্ডাস রিভার তাদের মধ্যে দ্বিতীয়৷ এশিয়ার বৃহত্তম নদীগুলির অন্যতম এই নদ ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে৷ কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা এই নদীর সঙ্গে জড়িত, কিন্তু অবকাঠামো ও পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক নদীতে গিয়ে পড়ে৷
ছবি: Asif Hassan/AFP/Getty Images
৩) হোয়াংহো নদী
মাছ-মাংসের ভিতর দিয়ে প্লাস্টিক মানুষের খাদ্যেও পৌঁছাতে পারে৷ চৈনিক সভ্যতার জন্মই নাকি হোয়াংহো নদীর তীরে৷ সেই নদীর কিন্তু প্লাস্টিক ছাড়া আরো অনেক সমস্যা আছে৷ দূষণের ফলে এই নদীর পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পানের অযোগ্য হয়ে উঠেছে৷ নদীতে বিভিন্ন মাছের প্রজাতির প্রায় ৩০ শতাংশ ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা৷
ছবি: Teh Eng Koon/AFP/Getty Images
৪) হাই নদী
এই নদীটি চীনের দু’টি সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহুরে এলাকা তিয়ানজিন ও বেইজিংয়ের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে, তারপর বোহাই সাগরে গিয়ে পড়ে, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ঘন জাহাজ চলাচল এলাকাগুলির অন্যতম৷ তালিকার ১০টি নদীর সব ক’টির ক্ষেত্রেই কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়: তীরে ঘনবসতি, সেই সঙ্গে বর্জ্য অপসারণের অবকাঠামো ও রিসাইক্লিং চেতনার অভাব৷
ছবি: Imago/Zumapress/Feng Jun
৫) নীল নদ
নীল নদ ১১টি দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে শেষমেষ মিশরে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়ে৷ নদীর অববাহিকায় প্রায় ৩৬ কোটি মানুষের বাস৷ নীল নদের পানি সেচের কাজেও ব্যবহার করা হয়, কেননা, কৃষিকাজ এই এলাকার মূল উপজীব্য৷ সেচ ও গ্রীষ্মের খর তাপমাত্রার কারণে নদীর পানি মাঝে মধ্যে সাগর অবধি পৌঁছায় না৷ তবুও প্লাস্টিক বহন করার ক্ষেত্রে নীল নদ পঞ্চম স্থানে৷
ছবি: Imago/Zumapress
৬) গঙ্গা নদী
ভারতের ৫০ কোটি মানুষের কাছে গঙ্গা নদী ধর্মজীবন ও দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ৷ পয়ঃ বর্জ্য, কৃষি ও শিল্প-কারখানার বর্জ্যের ফলে গঙ্গা নদী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে৷ সেই সঙ্গে টন টন প্লাস্টিক এই নদীতে গিয়ে পড়েছে৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে পানি থেকে প্লাস্টিক সরিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না, প্লাস্টিকের ব্যবহার ও প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎপাদন কমাতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Kanojia
৭) পার্ল রিভার
চীনের পার্ল রিভার বা মুক্তা নদী দূষণের জন্য সুবিদিত৷ এই নদী হংকং আর ম্যাকাওয়ের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে গিয়ে পড়ে৷ এলাকাটির অবিশ্বাস্য নগরায়ণের ফলে বিপুল পরিমাণ পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্প বর্জ্য পার্ল নদীর ব-দ্বীপে গিয়ে পড়ে৷ প্রধানত কৃষি এলাকাটি সত্তরের দশক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম নাগরিক এলাকাগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Goh Chai Hin
৮) আমুর নদ/হাইলং নদী
নগর ও শিল্পাঞ্চলে পৌঁছানোর পরেই নদীতে প্লাস্টিক বাড়ে৷ কিন্তু বর্তমানে প্রত্যন্ত ও প্রকৃতি প্রধান অঞ্চলেও নদীতে প্লাস্টিক দেখা দিতে শুরু করেছে৷ আমুর নদের উৎস উত্তর-পূর্ব চীনের পর্বতাঞ্চলে৷ পরে এই নদ চীনের হাইলংজিয়াং প্রদেশ ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ার মধ্যে সীমান্ত নদী হিসেবে কাজ করার পর ওখোটস্ক সাগরে গিয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/Chu Fuchao
৯) নাইজার নদী
পশ্চিম আফ্রিকার মুখ্য নদী নাইজার যে শুধু ১০ কোটি মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, তাই নয়, এই নদীর দু’কূলে প্রকৃতি তার আদিম প্রাচুর্য আজও বজায় রেখেছে৷ নাইজার নদী পাঁচটি দেশের ভিতর দিয়ে বয়ে শেষে নাইজেরিয়ায় অতলান্তিক মহাসাগরে গিয়ে পড়ে৷ প্লাস্টিক দূষণ ছাড়াও বিভিন্ন বাঁধ প্রকল্পের ফলে নদীর জল কমেছে৷ সেই সঙ্গে রয়েছে নাইজারের ব-দ্বীপে খনিজ তেল শিল্প, যা থেকে একাধিক বার তেল বেরিয়ে নদী দূষিত করেছে৷
ছবি: Getty Images
১০) মেকং নদী
মেকং নদীতেও একাধিক বাঁধ প্রকল্পের ফলে পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ মেকং নদীর বদ্বীপে প্রায় দু’কোটি মানুষের বাস৷ তাঁদের অনেকেই পেশায় ধীবর বা কৃষিজীবী৷ নদীটি ভিয়েতনাম ও লাওসসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়৷ প্রতিবছর বিশ্বের নদীগুলো থেকে মোট ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক সাগরে গিয়ে পড়ে, যার অধিকাংশই আসে মেকং ও তালিকার অন্যান্য নদীগুলি থেকে৷