বয়স ৮০ হলেও মনটা শিশুর মতো৷ সুইজারল্যান্ডের এক শিল্পী তাঁর শিশুসুলভ মনন নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের নানা উপকরণ দিয়ে অদ্ভুত শিল্পসৃষ্টি করে চলেছেন৷ সেই শিল্পের মর্ম বুঝতেও সাহায্য করছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
সুইজারল্যান্ডের রোমান সিগনার শিল্পের ক্ষেত্রে কিছুটা নিঃসঙ্গ ও অদ্ভুত বলেই পরিচিত৷ তাঁর সৃষ্টিকর্ম দেখে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, এর অর্থ কী? রকেট জুতো, রকেট টুপি কি শিল্প হতে পারে? এক স্বয়ংক্রিয় ঘাস কাটার যন্ত্র ও একটি ঘণ্টার মধ্যে কখনো কি সাক্ষাৎ ঘটবে?
তাঁর সৃষ্টিকর্মে ভাঙচুর ও তার শব্দের ছাপ পাওয়া যায়৷ নীল পিপা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি চলে৷ বেশ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বটে! রোমান সিগনার নিজে বলেন, ‘‘ধ্বংসাত্মক আসলে কী? হয়তো ছাদ থেকে ঝরে পড়া বরফ৷ উপরের সেই পিপা পানিতে ভরা৷ প্রত্যেকটিতে ২০০ লিটার পানি রয়েছে৷ দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে৷ এক বিশেষজ্ঞ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেই দড়ি কেটে দিয়েছেন, এবার সে সব নীচের দিকে ধেয়ে আসছে৷ চাষি যে অনুমতি দিয়েছেন, তা অসাধারণ, তাই না?’’
দৈনন্দিন জীবনের নানা বস্তু আর্ট ইনস্টলেশন হয়ে ওঠে৷ ফ্যান থেকে বাতাস বের হচ্ছে৷ এ নিয়ে খুব বেশি ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন নেই৷ ব্যাখ্যা খোঁজার ক্ষেত্রে শিল্পী নিজেই সাহায্য করেন৷ রোমান বলেন, ‘‘ভালো আবহাওয়া, খারাপ আবহাওয়া আসলে কী? একবার আইসল্যান্ডে গিয়েছিলাম৷ সঙ্গে ছাতা ছিল৷ কিন্তু সে দেশের জন্য তা একেবারেই উপযুক্ত নয়৷ সেখানকার বাতাস ছাতাকে ঘৃণা করে৷ সব ভেঙে দেয়৷ সবাই বর্ষাতি, টুপি পরে – কখনো ছাতা খোলে না৷ কেনারই উপায় নেই৷’’
জাদুকরের মতো ভেলকি দেখাতে পারেন এই শিল্পীরা!
সত্যি না মিথ্যে? কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে? যা দেখছি, তা কি শিল্প, না স্বপ্ন, না জাদু কিংবা মায়া? অতিবাস্তব অঙ্কণ বা ত্রিমাত্রিক স্ট্রিট আর্ট কাকে বলে, জানেন? আসুন তাহলে আমাদের ছবিঘরে৷
ছবি: Mirjana Kika Milosevic
হাওয়ার্ড লি’র অতিবাস্তব চিত্রাঙ্কণ
বলুন দেখি, ছবিতে দু’টি ‘হট ডগ’-এর মধ্যে কোনটি বাস্তব আর কোনটি মায়া? হাওয়ার্ড লি এমন নিখুঁতভাবে ছবি আঁকেন যে, বস্তু আর তার প্রতিমূর্তির মধ্যে ফারাকটা ধরার উপায় নেই, যদি না লি-র নিজের আপলোড করা ইউটিউব ভিডিওগুলো দেখেন৷ লি-র প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার নিয়মিত ফলোয়ার৷ তাহলে বলেই দেওয়া যাক– সত্যিকারের হট ডগটা বাঁদিকে৷
ছবি: DW
সিলভিয়া ভাল্ডের কৃত্রিম সসেজ
নিজে নিরামিষাশী হয়েও কিন্তু সিলভিয়া যে খেলনা বা বালিশগুলো তৈরি করেন, সেগুলো সসেজ, বেকন অথবা কিমার রূপ নেয়৷ বার্লিনে সিলভিয়ার ‘মাংসের দোকানে’ ৪০টি এ ধরনের শিল্পকলা দেখতে পাওয়া যাবে৷ তবে সসেজের আকারের বালিশ বা মুরগির ঠ্যাংয়ের আকারের কোল-বালিশ দেখে আশ্চর্য হবেন না কিন্তু!
ছবি: DW
অ্যালেক্স চিনেকের মায়াবি স্থাপত্য
লন্ডনের কোভেন্ট গার্ডেন শপিং স্কোয়ারের প্রবেশপথে এই বাড়িটিকে দেখতে পাবেন – যেন মাঝখান থেকে কে বা কারা ভেঙে দিয়েছে৷ ব্রিটিশ শিল্পী অ্যালেক্স চিনেক ২০১৪ সালে এই ইনস্টলেশনটি সৃষ্টি করেন, যার রহস্য হলো একটি অদৃশ্য ইস্পাতের কাঠামো৷ চিনেক বলেন, যাঁরা সাধারণত মিউজিয়ামে যান না, তাঁদের জন্যই তাঁর শিল্পকলা৷
ছবি: Rob Stothard/Getty Images
লেয়ন কিয়ারের ত্রিমাত্রিক স্ট্রিট আর্ট
ওলন্দাজ শিল্পী লেয়ন কিয়ার পথেঘাটে তাঁর ত্রিমাত্রিক ছবিগুলি প্রদর্শন করেন৷ কম্পিউটারে ছবিগুলির নকশা করে, পরে অকুস্থলে সেগুলিকে ‘প্রোজেক্ট’ করেন কিয়ার৷ ত্রিমাত্রিক অনুভূতি পাবার জন্য ছবিটিকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে৷
ছবি: DW
মিরিয়ানা মিলোসেভিচের ‘মায়ার’ শরীর
বডি পেইন্টিং মানে নিজের বা অপরের শরীরকে চিত্রপট হিসেবে ব্যবহার করে ছবি আঁকা৷ ‘কিকি’ নামের সার্বিয়ান শিল্পী মিরিয়ানা মিলোসেভিচ বডি পেইন্টিংকে বডি ইলিউশন বা বিদেহী মায়া করে তোলেন কালো পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে৷ মেক-আপ শিল্পী মিলোসেভিচ তখন নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারেন না, কেননা, তাহলে ইলিউশন বা মায়াটি ভঙ্গ হবে৷ নিজের বাস্তব থেকে মায়ায় উত্তরণের ভিডিও ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে থাকেন ‘কিকি’৷
ছবি: Mirjana Kika Milosevic
5 ছবি1 | 5
কবিতার মতোই কোমল ও হালকা তাঁর শিল্প৷ বালুর উপর ছড়ি দিয়ে আঁকিবুকি কাটা রয়েছে৷ আছে একটি বেলুন৷ রোমান সিগনার-এর এই শিল্পকর্ম চার্লি চ্যাপলিনের কথা মনে করিয়ে দেয়৷ তিনি তৈরি করেছেন পানি ছাড়াই এক কায়াক নৌকা৷ এটাই হলো সুইজারল্যান্ডের অরাজকতার নিদর্শন৷
আরেক সৃষ্টি সম্পর্কে রোমান সিগনার বলেন, ‘‘সামরিক সাজসরঞ্জামের মতোই সব হেলিকপ্টারও হুবহু একরকমভাবে প্রস্তুত করা হয়৷ সবকটি একসঙ্গে চালু হলে চরম অরাজকতার সৃষ্টি হয়৷ তারা একে অপরকে ধ্বংস করে মাটিতে পড়ে যায়৷’’
সবকিছুই দৈনন্দিন জীবনের বস্তু দিয়ে তৈরি৷ যেমন ঘাস কাটার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও ঘণ্টার মধ্যে রোমিও ও জুলিয়েটের মতো রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ অথবা অর্ধগোলাকার এক চিত্র৷ নিখুঁতভাবে অসম্পূর্ণ, সেইসঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিরোধী৷ সিগনার বলেন, ‘‘আজকের শিল্পীর চরিত্র ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আমি নিজেকে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না৷ প্রকৃতির কোলে যেতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে৷ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করি৷ নদী, বাতাস দেখে মনে আইডিয়া আসে৷ সেটাই তো যথেষ্ট, তাই না?’’
রোমান সিগনার শিল্পকে উঁচু আসন থেকে টেনে নীচে নামিয়েছেন৷ তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করেন, খেলাও করেন, অর্থহীন কাণ্ড ঘটান৷ ৮০ বছর বয়সেও তিনি শিশু থেকে গেছেন৷ শিল্পী নিজে বলেন, ‘‘সেই অর্থে আমার কোনো বিকাশ ঘটেনি৷ শিশুরা যা মন চায় তাই করে, শিল্প নিয়ে ভাবে না৷ শিল্প মানে যা ভালোভাবে করা যায়, তাই না?’’
রাল্ফ ড্যোরভাং/এসবি
নাচোলের আলপনা গ্রাম
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা৷ এখানকার একটি গ্রামের সব নারীরাই শিল্পী৷ তাঁদের শিল্পকর্মের ছোঁয়া সেখানকার প্রতিটি বাড়ি ঘরেই দেখা যায়৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আলপনা গ্রাম
তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিধন্য নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের গ্রাম টিকইল৷ এ গ্রামটিকে সবাই এখন চেনেন ‘আলপনা গ্রাম’ হিসেবে৷ হিন্দু-অধ্যুষিত এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে শোভা পায় হাতে আঁকা নানা আলপনা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আলপনার কারিগর
টিকইল গ্রামের আলপনার মূল কারিগর হচ্ছেন এ গ্রামের গৃহিণী আর মেয়েরা৷ বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
দেয়ালই যাঁদের ক্যানভাস
নাচোলের আলপনা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালই যেন একেকটি ক্যানভাস৷ মাটির তৈরি এ সব বাড়ির ভেতরের-বাইরের কোনো দেয়ালই বাদ পড়ে না তুলির আঁচর থেকে৷ রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর, প্রতিটি দেয়ালই মেয়েরা ভরে ফেলেন হাতে আঁকা আলপনায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আলপনায় আশীর্বাদ
টিকইল গ্রামের নারীরা বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এঁকে বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনা করে থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
পূজা-পার্বণে
টিকইল গ্রামের নারীরা বাড়ির দেয়ালগুলোতে সবচেয়ে বেশি আলপনা আঁকেন পূজা-পার্বণ উপলক্ষ্যে৷ এ সব বর্ণিল আলপনা বছর ধরে শোভা পায় দেয়ালজুড়ে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আলপনা স্থায়ী করতে
বাড়ির দেয়ালে আঁকা আলপনা স্থায়ী করতে রং-ও তৈরি করেন অনেক গৃহিনী৷ শুকনো বড়ই, আম আঁটির শাঁস চূর্ণ, চকগুঁড়া, মানকচু ও কলাগাছের কস বিভিন্ন রঙের সঙ্গে মিশিয়ে তাঁরা নিজেদের মতো রং তৈরি করেন৷ ওই রঙে আঁকা আলপনা সারা বছর টিকে থাকে মাটির দেয়ালে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
এক ক্ষুদে আলপনা শিল্পী
স্কুল পড়ুয়া রীমা বর্মন মা এবং দাদির আঁকা দেখে দেখে আলপনা আঁকতে শিখেছে৷ তাই কোনো উৎসব এলেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যায় রং-তুলি নিয়ে৷ তার বয়সি গ্রামের অনেক মেয়েকে আলপনা আঁকার তালিমও দেয় সে৷