সন্তান হারানো যে কোনো বাবা-মায়ের জন্যই অপরিসীম বেদনার৷ অথচ সন্তান কখন যে হারিয়ে যায় অনেক বাবা-মা তা বুঝতেই পারেন না৷ বোঝেন যখন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, সব বন্ধন ছিঁড়ে সন্তান ততক্ষণে চলে গেছে জীবনের ওপারে৷
বিজ্ঞাপন
গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলা চালানো জঙ্গিদের পরিচয় জেনে অনেকেই বিস্মিত৷ এত ধনাঢ্য, অভিজাত পরিবারের সন্তানরা কী করে জঙ্গি হয়, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা ‘আধুনিক' তরুণরা কিভাবে ধর্মের নামে এত নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করে – তা তারা ভেবেই পাচ্ছেন না৷ অথচ আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং ইংরেজিজ্ঞান কখনোই আধুনিকতা আর মানবিক শিক্ষার নিয়ামক নয়৷ ‘জঙ্গি মানেই মাদ্রাসাছাত্র' – এমন ধারনার অসারতার প্রমান তো আমরা অতীতেও অনেকবার পেয়েছি৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের উপর বিভিন্ন হামলায় মাদ্রাসা এবং সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার কথা বলছে গোয়েন্দারা৷ এই নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা এনএসইউ-এর পাঁচ ছাত্র৷ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়৷ এরা সকলেই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মগজ ধোলাই
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর ছাত্র মোহাম্মদ নুরউদ্দনি এবং আবু বারাকাত মোহাম্মদ রফকিুল হাসান হাসানকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে পুলিশে দেয়া হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
হিযবুত তাহরীরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের আইবিএ-র শিক্ষক ছিলেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের কারখানা বলা হতে একসময়৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক দু’জন নিজেদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দাবি করেছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
সতর্ক পুলিশ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জঙ্গি বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্য সানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এখন জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকছে৷ আর যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে, তারাও বয়সে তরুণ এবং ছাত্র৷''
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
6 ছবি1 | 6
ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার আটজন আসামির সাতজনই যে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র – তা কি আমরা ভুলে গেছি?
আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর আসামীদের সঙ্গে গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারীদের বড় একটা পার্থক্য হলো, এই হামলাকারীদের পরিচয় এবং অপরাধ সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি বা সংশয়ের অবকাশ নেই৷ এই জঙ্গিরা ‘আত্মস্বীকৃত' জঙ্গি৷ ঘটনাপরম্পরায় এইটুকু অন্তত বলা যেতেই পারে৷
কিন্তু এই তরুণরা কেমন করে হঠাৎ জঙ্গি হয়ে গেল অনেকের কাছে সেটাই যেন বিস্ময়ের৷ তাদের পরিবারও নাকি বিষয়টা বুঝতে পারেনি৷ এক জঙ্গির পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার খবর পুলিশকেও নাকি জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পুলিশ তখন বিষয়টিকে আমলে নেয়নি৷ তাদের মনে হয়েছে, বড় লোকের ছেলেটি হয়ত কোথাও বেড়াতে গেছে, সময়মতো ঠিকই ফিরে আসবে৷
কিন্তু ছেলেটি আর ফেরেনি৷ নিরীহ কিছু মানুষকে মেরে নিজেও মৃত্যুবরণ করেছে৷
প্রশ্ন জাগে, বাবা-মায়ের দায়িত্ব কি শুধু সন্তানের ভরনপোষণ আর লেখাপড়ার খরচ জোগানো? সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে – এ সব সম্পর্কে উদাসীনতা যে কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত তো বহুবার আমরা দেখেছি৷ এমন উদাসীনতার কারণেই নেশার রাজ্যে ডুবে নিজের বাবা-মাকেই হত্যা করেছে ঐশী৷ ওর সামনে এখন ফাঁসির দড়ি৷ আদালত শাস্তি মওকুফ না করলে হয়ত কৈশোরেই শেষ হয়ে যাবে একটি জীবন৷
ঐশীর বাবা-মাকে তবু সন্তানের মৃত্যু দেখে যেতে হয়নি৷ জঙ্গিদের মা-বাবাকে তা দেখতে হলো৷ দেখতে হলো প্রায় তাদের সন্তানেরই বয়সের ছেলে ফারাজের মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ দুই বন্ধুর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে ফারাজ৷ সারা বিশ্বের গণমাধ্যম তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷
অন্যদিকে জঙ্গিরা৷ তাদের পরিচয়, তাদের কৃতকর্ম পরিবারকেও শুধু দুঃখ আর গ্লানিই দিয়েছে৷
এই গ্লানিতে রাষ্ট্র এবং সমাজেরও দায় নিশ্চয়ই আছে৷ কিন্তু পরিবারও দায় এড়াতে পারে না৷ কোনো কিছুই হঠাৎ ঘটে না৷ গুলশানের জাতীয় ট্র্যাজেডি সব পরিবারের জন্যই এক সতর্কবার্তা৷ পরিবারের সবাই, বিশেষ করে বাবা-মা সব সময় উঠতি বয়সের সন্তানদের পাশে থাকুন৷ ওদের ভরসা হয়ে থাকুন, ছায়া হয়ে থাকুন যেন কোনো খরতাপেই কচি কচি জীবনগুলো হঠাৎ জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে না যায়!
লেখকের সঙ্গে আপনি কি একমত? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷
বিভীষিকার ১২ ঘণ্টা
ঢাকার গুলশানের আর্টিজান ক্যাফেতে দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার জিম্মি ঘটনার অবসান হলেও মানুষের মন থেকে আতঙ্ক যাচ্ছে না৷ এ ঘটনায় শুক্রবার রাতেই নিহত হয়েছে ২০ জিম্মি৷ নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
ঘটনার শুরু
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালালে অবস্থানরত অজ্ঞাত সংখ্যক অতিথি সেখানে আটকা পড়েন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু
পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নিহত হন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধারের পাশাপাশি ছ'জন হামলাকারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ বলেছেন, বাকি কয়েকজনকে হয়তো বাঁচানো যায়নি৷ এই জঙ্গি হামলায় জড়িত একজন ধরা পড়েছে বলেও শনিবার সকালে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: Reuters
এ যেন দুঃস্বপ্ন
কমান্ডো অভিযানে মুক্ত গুলশানের ক্যাফে থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তিদের ১২ ঘণ্টার ‘দুঃস্বপ্ন’ কাটছে না৷ তাঁদের চোখে মুখে ক্লান্তি ও ভীতির ছাপ৷ তারা বলছিলেন, কয়েকজনের মৃতদেহ দেখেছেন, অনেক জায়গায় রক্তের ছাপ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
তাঁরা বলছেন, জিম্মিকারীরা বাংলাদেশি মুসলমানদের সুরা পড়তে বলে৷ সুরা পড়তে পারার পর তাঁদেরকে রাতে খেতেও দেওয়া হয়৷ যাঁরা হিজাব পরা ছিল, তাঁদের বাড়তি খাতির করা হয়৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/S. K. Das
আইএস-এর দায় স্বীকার
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ জানিয়েছে৷ এই জঙ্গি দলের মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে এ সব খবরে দাবি করা হয় যে, ‘তাদের’ এই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪০ জন৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কমান্ডো অভিযান
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়৷ ৮ টা ১৫ মিনিটে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ভবনের নিয়ন্ত্রণ ও আতঙ্কের অবসান
৮ টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা৷ গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে৷ ৯ টা ১৫ মিনিটে ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়৷