অবশেষে কৃষক আন্দোলনের সামনে অনেকটাই নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলো নরেন্দ্র মোদী সরকার।
বিজ্ঞাপন
কৃষক আন্দোলনের চাপে পিছু হঠতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারের প্রস্তাব, তারা দেড় বছর তিন বিতর্কিত কৃষি আইন স্থগিত রাখবে। কৃষক নেতারা চাইলে সুপ্রিম কোর্টে লিখিত হলফনামা দিতেও সরকার রাজি। বিনিময়ে কৃষকদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে।
কৃষক সংগঠনগুলি এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা এখন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহস্পতিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক সেরে শুক্রবার আবার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন কৃষক সংগঠনের নেতারা। তখন তাঁরা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবেন। কৃষকরা এখনো যে দাবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, তা হলো, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য(এমএসপি) বাধ্যতামূলক করার জন্য আইন করা। যাতে সকলেই এই সহায়ক মূল্য মানতে বাধ্য হয়।
কৃষকদের দাবি ছিল, তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। কিন্তু সরকার এতদিন ধরে রাজি হয়নি। বরং তারা অনড় থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, এই দাবি মানা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন, তিনটি আইন কৃষকদের প্রভূত উপকার করবে। বিরোধীরা যা বলছে তা ঠিক নয়। বিজেপি-র তরফেও বারবার একই কথা প্রচার করা হচ্ছিল। এমনকী দেশের কৃষকদের একটা বড় অংশ যে কৃষি বিলের সমর্থনে, সে কথাও বলা হচ্ছিল। কিন্তু কৃষকরাও এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি হননি। তাঁরা নিজেদের দাবিতে নিয়ে অনড় থেকেছেন। অবশেষে সরকার দেড় বছরের জন্য কৃষি আইন স্থগিত রাখতে রাজি হয়েছে।
কৃষক বিক্ষোভ ও ট্রাক্টর প্রতিবাদ
দিল্লির সীমানায় কৃষক বিক্ষোভ চলছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকরা দিল্লিতে ট্রাক্টর মার্চ করার পরিকল্পনা করেছে।
ছবি: Altaf Qadri/AP/picture-alliance
সরকারি আলোচনা বিফল
মোদী সরকারের সঙ্গে বহুবার আলোচনায় বসেছেন বিক্ষোভরত কৃষক নেতারা। কিন্তু এতবার আলোচনার পরেও কোনো সমাধানসূত্র পাওয়া যায়নি। কৃষকদের মূল দাবি মানতে চায়নি সরকার।
ছবি: Sameeratmaj Mishra/DW
সুপ্রিম কোর্টের কমিটি
বিক্ষোভরত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মেটাবার জন্য কমিটি করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারও আগে কমিটি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখনো কৃষকরা রাজি হয়নি। এবারও তাঁরা বলেছেন, কমিটি তার কাজ করতে পারে। কিন্তু তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Kachroo
কৃষকদের মূল দাবি
কৃষকদের প্রধান দাবি হলো, বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। আইন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর তাঁদের চুক্তি চাষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্য করা যাবে না।
ছবি: Mohsin Javed
সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে
সুপ্রিম কোর্টের রায় হলো, আপাতত তিনটি কৃষি আইনের রূপায়ণ স্থগিত থাকবে। একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে সমাধানসূত্র খুঁজে বের করবেন।
ছবি: Mohsin Javed
কৃষকরা কেন মানছেন না
কৃষক নেতারা মনে করেন, সরকার চাইছে, কৃষকরা আন্দোলন থামিয়ে দিল্লির সীমানা ছেড়ে চলে যাক। সুপ্রিম কোর্টের কমিটি যে তাঁদের দাবি মানবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কমিটির অধিকাংশ সদস্যই অতীতে কৃষি বিলের সমর্থন করেছেন। তাই দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন করবেন।
ছবি: Seerat Chabba/DW
দিল্লির সীমানায় বসে কৃষকরা
গত ৪৯ দিন ধরে কৃষকরা দিল্লির সীমানায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের সঙ্গে দিল্লির যে সীমানা আছে, তার বেশির ভাগ জায়গায় কৃষকদের বিক্ষোভ চলছে। দিল্লিতে এখন প্রবল শীত। তার মধ্যেই কৃষকরা বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Seerat Chabba/DW
বহু কৃষকের মৃত্যু
কৃষক বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত আন্দোলনরত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। শীত সহ্য করতে না পেরে অনেকে মারা গেছেন। তবে তারপরেও বিক্ষোভ থামেনি।
ছবি: Sameeratmaj Mishra/DW
প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিকল্পনা
আগামী ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথে সামরিক বাহিনীর প্যারেড হয়। সেখানে ভারতের সামরিক শক্তির পাশাপাশি উন্নয়নের নজির এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। কৃষকরা ঠিক করেছেন, সেদিন তাঁরাও দিল্লিতে ট্রাক্টর প্যারেড করবেন।
ছবি: Reuters/A. Hussain
সরকারের আপত্তি
মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠনে কোনো ব্যাঘাত ঘটলে তা দেশের কাছে বিড়ম্বনার কারণ হবে। কিন্তু যোগেন্দ্র যাদবের দাবি, তাঁরা জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানাতেই এই পরিকল্পনা করেছেন।
ছবি: Seerat Chabba/DW
9 ছবি1 | 9
প্রশ্ন হলো, পুরোপুরি বাতিল না করে, দেড় বছরের জন্য কেন স্থগিত রাখা হবে ওই বিতর্কিত আইন? সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, কৃষকদের বিষয়টি বোঝানো হবে। কিছু পরিবর্তন করে নতুন আইন চালু করতে তাঁরা রাজি হলে, তখন আবার আইন চালু হতে পারে। সেজন্য একেবারে বাতিল না করে আইনটি দেড় বছরের জন্য স্থগিত রাখার কথা বলা হয়েছে। তাতে কর্পোরেটদেরও বার্তা দেয়া সম্ভব হলো।
কী করবেন কৃষকরা?
সিপিএমের কৃষক নেতা ও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হান্নান মোল্লা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''সংগঠনগুলি আলোচনায় বসেছে। তারা এথন সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সিদ্ধান্ত সরকারকে জানানো হবে।''
কৃষকদের সামনে তিনটি বিকল্প আছে। এক, সরকারের এই প্রস্তাবও খারিজ করে দেয়া। দুই, এই প্রস্তাব মেনে নেয়া। তিন, এই প্রস্তাব মেনে আরো কিছু দাবি মানার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা। যার মধ্যে অন্যতম হলো এমএসপি-র দাবি। স্বরাজ পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতে, এমএসপি-র দাবি রাজনৈতিক ও আর্থিক দিক থেকে মানা সম্ভব। তবে এর জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি দরকার।
কেন এই পিছিয়ে যাওয়া
গত প্রায় দুই মাস ধরে কৃষকরা দিল্লির সীমানায় আন্দোলন করছেন। তাঁদের ঠেকাতে সরকার কম চেষ্টা করেনি। তাদের দিল্লির সীমানায় আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। জলকামান, লাঠি চালানো হয়েছে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। কৃষকদের অভিযোগ, বিজেপি শাসিত রাজ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে ৬০ জনের বেশি কৃষক হয় মারা গেছেন বা আত্মহত্যা করেছেন। এই আন্দোলন এখন দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়েছে। আর ভারতে যেহেতু প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল, তাই কৃষকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে তাদের তুলে দিতে পারেনি মোদী সরকার। কৃষকদের রাগ কতটা তা হরিয়ানা, পাঞ্জাবে বোঝা গেছে। হরিয়ানায় কৃষকরা মুখ্যমন্ত্রীকে জনসভা পর্যন্ত করতে দেয়নি। ফলে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন মোদী, হারাচ্ছিল বিজেপি। সেজন্যই পিছিয়ে এলো সরকার।
দিল্লির রাজপথের দখল নিচ্ছেন কৃষকরা
বিতর্কিত আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের কৃষকরা ভারতের রাজধানী দিল্লির পথে নেমেছে৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: IANS
ব্যর্থ আলোচনা
রাজধানী দিল্লি ও হরিয়ানার সীমান্তে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন কৃষকরা৷ সদ্য পাস হওয়া কৃষি বিল মানতে না পারায় সরকারের সাথে আলোচনায় বসছে কৃষক সংগঠনগুলির নেতৃত্ব৷ কিন্তু এখনো কোনো সুরাহা হয়নি৷ চলছে কৃষকদের অবস্থান বিক্ষোভ৷
ছবি: Moshin Javed
ছাড় নেই
কৃষকদের দাবির মুখে এখনো অনড় কেন্দ্রীয় সরকার৷ প্রতিবাদী কৃষকরা যাতে দিল্লির মূল রাস্তায় না ঢুকতে পারেন, সেজন্য যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Moshin Javed
কর্পোরেটের দখল
ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সম্প্রতি সংসদে তিনটি কৃষি বিল পাশ করেছে৷ নতুন নিয়মের আওতায় এখন আর ফসলের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করতে পারবেন না কৃষকরা৷ খোলা বাজারের নিয়ম মেনেই ঠিক হবে ফসলের দাম৷ কৃষকদের বক্তব্য, এই নিয়মের কারণে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রভাব বাড়বে, কমবে ফসল ফলানো কৃষকদের অধিকার৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
ফসলের ন্যূনতম দাম
এমএসপি বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের ব্যবস্থা এতদিন নিশ্চিত করেছে ফসলের দাম৷ এই এমএসপির সুবিধা তুলে দেওয়ায় বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা কৃষকদের ক্ষতির কারণ হতে পারে৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
চাপে স্থানীয় নেতৃত্ব
যদিও স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব বলছে যে, এমএসপির সুবিধা সরানো হবে না, কৃষক সংগঠনগুলির মত, তবুও বাড়বে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট হস্তক্ষেপ, যার কোপ এসে পড়বে ছোট চাষীদের ওপরেই৷ প্রতিবাদে বিজেপি কার্যালয়গুলির সামনে ও নেতাদের বাসস্থানের বাইরেও অবস্থানে রয়েছেন কৃষকরা৷ অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলে, যেখানে কৃষিনির্ভর পরিবারের বাস, সেখানে সমর্থন হারাচ্ছে বিজেপি৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
পাঞ্জাবের রাজনীতিতে প্রভাব
কৃষক সংগঠনগুলি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলকে এই প্রতিবাদে না টানলেও, তাদের এই প্রতিবাদ সরকারকে চাপে রাখছে৷ পাঞ্জাবে বহুদিন ধরেই বিজেপির জোটসঙ্গী আকালি দল, যারা চলমান প্রতিবাদের পরিস্থিতিতে জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে৷ বলা হচ্ছে, এমনটা তারা করেছে স্থানীয় সমর্থন না হারাতে৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
সম্মানের, জীবিকার প্রশ্ন
পাঞ্জাবে একজন কৃষক গড়ে এক থেকে দুই হেক্টর জমির মালিক৷ তবে সেই জমি থেকে আয় খুব একটা বেশি নয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের খরচ চালানোর জন্য তা যথেষ্টই হয়৷ ভারতের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ১২০ কোটি মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল৷ ফলে, তাদের জন্য এই প্রতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
কিছু বদলাবে কি?
কৃষকদের মত, তাদের সমস্যা শুনতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ৷ উল্টোদিকে, কৃষকদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ, তারা ‘নতুন বিলগুলি ঠিক করে পড়েনি’, তারা‘অর্থনীতি বুঝতে নারাজ’, এবং তারা ‘অতীতেই আটকে আছে’৷ কৃষকরা ‘রাজনৈতিক ঘুঁটি’, এমনটাও শোনা গেছে সরকারের তরফে৷ কৃষকরা হলফ করে বলতে পারছেন না এখনো কতদিন পথ আঁকড়ে পড়ে থাকবেন৷ কিন্তু প্রতিবাদ থেকে সরে এলে তাঁদের কথা প্রচার করবার কোনো পন্থা থাকবে না বলে মনে করেন তারা৷
ছবি: Seerat Chabba/DW
8 ছবি1 | 8
তার উপর কৃষকরা ২৬ জানুয়ারি ট্রাক্টর মিছিল করতে বদ্ধপরিকর ছিল। এটা ছিল মোদী সরকারের কাছে বিড়ম্বনার বড় কারণ। তারা সুপ্রিম কোর্টে নালিশও জানিয়েছিল। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, পুলিশ আগে এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিক। সরকার কোনোভাবে চাইছে না, ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা দিল্লির রাস্তায় ট্রাক্টর মিছিল করুক। তা হলে পুরো প্রচার তাদের দিকে চলে যাবে। ফলে কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে মোদী খুবই চাপে ছিলেন।
দ্বিতীয়বার পিছু হটল মোদী সরকার
গত ছয় বছরে একবারই পিছু হটেছিল মোদী সরকার। সেটা জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়ে। ইউপিএ আমলের বিল চালু করতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু কৃষকদের বিক্ষোভের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার পিছিয়ে যায়। এবার কৃষি বিল নিয়েও তারা পিছু হঠতে বাধ্য হলো।