বাংলাদেশে দুঃসংবাদই বেশি থাকে সংবাদ শিরোনামে৷ এমন দেশের প্রকল্প ‘তথ্যকল্যাণী’-র ‘দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ড’ জেতা নিঃসন্দেহে সুখবর৷ এই পুরস্কার নিতে জার্মানিতে এসে তথ্যকল্যাণীদের প্রতিনিধি মাহফুজা জানান তাঁর জীবন-যুদ্ধের কথা৷
বিজ্ঞাপন
‘যুদ্ধ' শব্দটি অবশ্য আনন্দের বার্তা খুব কমই বয়ে আনে৷ যুদ্ধ মানেই মারামারি-হানাহানি৷ সেখানে বিজয়ীর আনন্দ থাকে অবশ্যই, তবে সেই আনন্দের আড়ালে থাকে অনেক মৃত্যু্, অনেক কান্না৷ মাহফুজা আক্তার যুদ্ধে নেমেছিলেন হাসি ফোটাতে৷ চেয়েছিলেন পরিবারের অভাব-অনটন যতটা সম্ভব দূর করতে৷ শুধু ভাই-বোন, মা আর অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী বাবার মুখে হাসি ফোটালে গল্পটা সাধারণই থেকে যেত৷ কিন্তু তথ্যকল্যাণীরা সাধারণ ঘরের ‘অসাধারণ' সব মেয়ে৷ দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস, তাই বলে মানুষের সেবা করার আনন্দ নিতে নিতে পরিবারের সবার মুখে আহার তুলে দেয়ার ইচ্ছাপূরণের পথের সব বাধা অতিক্রমের সাহস তো কম নয়! মাহফুজা বাংলাদেশের গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার অতি সাধারণ এক পরিবারের তেমনি অসাধারণ এক মেয়ে৷
'শুরুটা সহজ ছিল না'
সেই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জীবনে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে পা রেখেছেন মাহফুজা৷ প্রথম বিদেশ সফরই জার্মানিতে৷ শুধু আসা আর যাওয়া নয়, ১৭ থেকে ১৯ জুন – এই তিন দিন ধরে জার্মানির বন শহরে চলা ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম'-এর সম্মানিত অতিথি হওয়া এবং শেষ দিনে তথ্যকল্যাণী প্রকল্পের গর্বিত কর্মী হিসেবে পুরস্কার গ্রহণ করা৷ পরিবার, এলাকাবাসী তো দূরের কথা মাহফুজা নিজেও ভাবেননি জীবনে এমন দিন কখনো আসতে পারে৷
বেসরকারি সংস্থা ডি নেট-এর প্রকল্প ‘তথ্যকল্যাণী' (ইনফোলেডি)-তে মাহফুজা এক সাধারণ কর্মী৷ কাজ করেন মাঠ পর্যায়ে৷ পরিবারে স্বচ্ছলতা নেই, উচ্চ মাধ্যমিকের পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে এক ভাই বেকার৷ মেয়েকে বিয়ে দেয়া বা আরো বেশি পড়ানো – কোনোটাই বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ সংসার চালানোই কঠিন, মেয়েকে পড়াবেন কী! বাবার অক্ষমতার জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও স্বাবলম্বী হয়ে মাহফুজা আক্তার আবার শুরু করেছেন লেখাপড়া৷ ভীষণ ব্যস্ততার ফাঁকে ডয়চে ভেলেকে দেয়া এই সাক্ষাৎকারে মাহফুজা পরিবারের তখনকার দুর্দশার বিবরণ দেননি৷ বিবরণ সেভাবে জানতেও চাওয়া হয়নি, বাংলাদেশের নিম্ববিত্তদের প্রতিটি ঘরে এ পরিস্থিতিতে এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক৷
গাইবান্ধার মাহফুজার জার্মানি সফর
তথ্যকল্যাণী মাহফুজা আক্তারের নিবাস বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে৷ সেই গ্রাম থেকে মাহফুজার জার্মানি সফরের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
ডয়চে ভেলের আমন্ত্রণ
তথ্যকল্যাণী মাহফুজা আক্তার এবং ‘তথ্যকল্যাণী গ্লোবাল’ প্রকল্পের পরিচালক মোশাররফ হোসেন জার্মানির বন শহরে পৌঁছান ১৬ জুন৷ উদ্দেশ্যে ডয়চে ভেলের ‘দ্য বব্স – বেস্ট অনলাইন অ্যাক্টিভিজম’ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ
জার্মানি সফরের শুরুর দিনেই ডয়চে ভেলের মহাপরিচালক এরিক বেটারমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান মাহফুজা আক্তার৷ গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিশেষ ডিনারে মাহফুজাকে অভিনন্দন জানান বেটারমান৷ পাশাপাশি তিনি স্মরণ করেন ১৯৭৩ সালে তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথা৷ সেসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এরিক বেটারমান৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
লাজুক মাহফুজা
ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম’ বিভাগে পুরস্কার জয়ের খবর প্রথম ধাক্কায় বিশ্বাসই করেননি মাহফুজা৷ পরর্বতীতে ডয়চে ভেলে থেকে সরাসরি ফোন পেয়ে আস্বস্ত হন তিনি৷ বনে আসার পরও ঠিক যেন স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না তিনি৷ বিশেষ ডিনারে তাই বাঙালিদের সঙ্গ পেয়েও তাঁর লাজুক ভাব কাটে না৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
গ্রাফিটি আঁকা
দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় জুরি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীরা গ্রাফিটি আঁকবেন, এমন পরিকল্পনা ছিল আগেই৷ ১৭ জুন তাই মাহফুজাও অন্য পাঁচ বিজয়ীকে নিয়ে যাওয়া হয় বনের এক ফুটবল মাঠের পাশের দেয়ালে৷ ইংরেজি ‘The Bobs’ শব্দ দুটিকে রং করেছেন বিজয়ীরা৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
তথ্যকল্যাণী
মাহফুজাকে বলা হয়েছিল, নিজের পছন্দের একটি শব্দ দেয়ালে লিখতে৷ তিনি লিখেছেন, ‘তথ্যকল্যাণী’৷ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া বিভাগের কর্মীরা তাঁর এই লেখালেখি প্রয়োজনমত ভিডিও করেছে, ছবি আকারে ধারণ করেছে৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
ওয়াও, বিউটিফুল!
ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে এবার অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল দু’হাজারের বেশি৷ স্বাভাবিকভাবেই তাই ফোরামের নৌভ্রমণে ভিড় হবে প্রচুর, এমন একটা ধারণা ছিল আগে থেকেই৷ ভিড় এড়াতে মাহফুজা আগেভাগেই হাজির হন জাহাজের কাছে৷ রাইনে থাকা জাহাজের দিকে তাকিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘ওয়াও, বিউটিফুল!’
ছবি: DW
জার্মান খাবারে অরুচি
জার্মানি কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহফুজার ছোট্ট জবাব, ‘খুব ভালো লাগছে৷’ তবে জার্মানি খুব ভালো লাগলেও জার্মান খাবার তেমন একটা পছন্দ হয়নি তাঁর৷ নৌভ্রমণে অনেকটা জোর করে এই আলুর অংশবিশেষ খেয়েছেন তিনি৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
প্রশংসা
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম সম্মেলনেকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই নৌভ্রমণে অনেকের দেখা পেয়েছেন মাহফুজা৷ তাদের একজন ডয়চে ভেলের এশিয়া বিভাগের প্রধান আলেকজান্ডার ফ্রয়েন্ড৷ মাহফুজার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বাংলাদেশে তথ্যকল্যাণীদের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
ওয়ার্কশপে মাহফুজা
১৮ জুন সকালে গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে এক ওয়ার্কশপে অংশ নেন মাহফুজা আক্তার৷ এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ‘ইনফোলেডি গ্লোবাল’-এর পরিচালক মোশাররফ হোসেন, জার্মান সংস্থা ‘ফ্রেইসার’-এর লুকাস ক্রিস্টিয়ান ফিশার এবং ‘চেঞ্জ.অর্গ’-এর পাউলা হানেরমান৷ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন ডয়চে ভেলের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান সায়ার৷
ছবি: DW
সাক্ষাৎকার পর্ব
দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় তথ্যকল্যাণী প্রকল্পের বিজয়ের খবর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল দেশিবিদেশি মিডিয়ার কাছে৷ ডয়চে ভেলে বিভিন্ন ভাষায় এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ মিডিয়া ফোরামে রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল মাহফুজা এবং মোশাররফের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের মাঝেই একটি অনুষ্ঠানে দ্য বব্স-এর জুরি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়৷ মাহফুজা আক্তারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক উটে শেফার৷ বাংলাদেশের তথ্যকল্যাণীদের প্রতিনিধি হিসেবে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন মাহফুজা৷
ছবি: DW
আমরাও পারি
দ্য বব্স পুরস্কার হাতে নিয়ে জানানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মাহফুজা বলেন, ‘‘শুরুতে তথ্যকল্যাণী হিসেবে আমাদের কাজ মোটেই সহজ ছিল না৷ তবে এখন গ্রামের মানুষ আমাদের সম্পর্কে জানে৷ আমরা গ্রামের মেয়ে হয়েও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছি, মানুষের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি৷’’
ছবি: DW
দ্য বব্স বিজয়ীরা
চলতি বছর দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় জুরি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণকারীদের মধ্যে মাহফুজাসহ অন্যরা হচ্ছেন সেরা ব্লগ ক্যাটেগরিতে লি চেনপেং, ‘সেরা সামাজিক আন্দোলন’ ক্যাটেগরিতে মরক্কোর তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগ ‘৪৭৫’-এর সদস্য হুদা লামকাদাম, ‘সেরা উদ্ভাবন’ ক্যাটেগরিতে ফ্রি উইবোর কার্ল লি এবং রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স ক্যাটেগরিতে সাংবাদিক ফাবি কুসাই-এর ভাই৷
ছবি: DW
মোশাররফ ও মাহফুজা
ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ উপলক্ষ্যে অনেকবার ছবির জন্য পোজ দিতে হয়েছে মাহফুজাকে৷ মাঝামাঝে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন মোশাররফ৷ ফ্লিকারে ডয়চে ভেলের পাতায় এসব ছবি পাওয়া যাবে৷
ছবি: DW
সবাইকে ধন্যবাদ
জার্মানিতে মাহফুজা বেশ লাজুক ছিলেন৷ তবে নিজ গ্রামে তিনি পরিচিত স্পষ্টবক্তা হিসেবে৷ জার্মানি থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে মাহফুজা ডয়চে ভেলের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি৷ মোশাররফের সঙ্গে ২০ জুন দুপুরে জার্মানি ত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
15 ছবি1 | 15
কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল মেয়ে হয়েও মাহফুজার সংসারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত৷ স্থানীয়দের অনেকে তাই মনে করতেন৷ তবে মাহফুজার সৌভাগ্য, একজন হিতাকাঙ্খী শিক্ষক ছিল তাঁর৷ তিনিই দিয়েছিলেন উদয়ন স্বাবলম্বী সংস্থার মাধ্যমে তথ্যকল্যাণী হয়ে পরিবার এবং সাতটি ইউনিয়নের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগের খবর৷ পরিবার এবং সমাজের কল্যাণ একসাথে৷ কাজ মূলত তথ্য দিয়ে সবার উপকার করা৷ খোঁজ-খবর নিয়ে কাজটা খুব পছন্দ হলো৷ সাইকেল চালিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে ছোটখাটো চিকিৎসা সেবা দেয়া; রক্তচাপ মেপে, রক্ত পরীক্ষা করে, কোনো নারীর গর্ভে সন্তান আসছে কিনা পরীক্ষা করে জেনে কাকে কী করতে হবে বলে দেয়া; কৃ্ষকদের নানা তথ্য-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা, প্রয়োজনে কাউকে ছবি তুলে দেয়া, দূরের আপনের সঙ্গে স্কাইপ-এ কথা বলানো, মোবাইল ঠিক করা, অনুষ্ঠানের ভিডিও করে দেয়া, ভিডিও দেখিয়ে শিশুদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগানো – সবই তো কল্যাণমূলক কাজ!
এভাবে সাতটি ইউনিয়নের মানুষের কল্যাণ করতে চেয়েও মাহফুজা পড়েছিলেন বাধার মুখে৷ প্রথমে সাইকেল চালানোর ব্যাপারটি মানতে চায়নি পরিবার৷ পরিবার মানলো, কাজে নামলেন, মাহফুজা দেখলেন, যে দেশের মেয়ে বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলনেত্রী, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার – বলতে গেলে প্রায় সবই হয়, সেই দেশের একটি গ্রামের মানুষ তাঁর সাইকেল চালানো মানতে পারছে না৷ বিদ্রুপ, কটাক্ষ, সমালোচনা সবই হয়েছে৷ ভালো কাজে এসবের গুরুত্ব যত কম দেয়া যায় ততই মঙ্গল৷ সেটা বুঝতেন বলেই মাহফুজারা সুদূর জার্মানিতেও পুরস্কৃত৷ বিদেশের দৈনিকেও শীর্ষ খবরে থাকে তথ্যকল্যাণীদের বিশ্বজয়ের খবর৷
দেখতে ছোট, কাজে বড় মাহফুজা অল্প সময়ে অনেক কথাই বলেছেন ডয়চে ভেলেকে৷ কথাগুলো তাঁর একার নয়৷ বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলে কর্মরত ৭৯ জন তথ্যকল্যাণীর জীবনকাহিনিও মোটামুটি একইরকম৷ ‘দ্য ববস - বেস্ট অফ অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড' তাঁদের প্রত্যেকের৷ মাহফুজা আক্তারের এই সাক্ষাৎকার আসলে সব তথ্যকল্যাণীকে শ্রদ্ধা জানানোরই প্রয়াস৷