জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে কোনো ব্যক্তির নাম না থাকার মানে তিনি ভিনদেশি৷ ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামের ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব এখন সেই প্রশ্নের মুখে৷ কেউ জানে না এরপর তাদের ভাগ্যে কি আছে৷
বিজ্ঞাপন
দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি বিদেশিমুক্ত করার কথা বলে আসছে কেন্দ্রের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর শাসক দল ও সরকারের পদাধিকারীরা জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, অন্য রাজ্যেও এনআরসি চালু করা হবে৷ বিশেষত করে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায়৷ ফলে দেশজুড়ে এক ধরনের এনআরসি জুজুর ভয় ছড়িয়ে পড়ছে৷
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো রাজ্যে এনআরসি চালু করতে হলে সেই বিষয়ে প্রস্তাবিত আইন পেশ করতে হয় সংসদে৷ সংসদের অনুমোদন ছাড়া তা সম্ভব নয়৷ এক আসাম নিয়ে সরকার ও শাসক দলের নাজেহাল দশা৷
অধীররঞ্জন চৌধুরি
এর উপর অন্য রাজ্যে এনআরসি চালু করার কোনো প্রস্তাব সংসদে পাশ হওয়া তো দূরের কথা পেশ করাই হয়নি৷ অতএব এখনই তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ যদিও কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এনআরসিকে সামনে রেখে দেশে অর্থনীতির করুণ দশা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতি করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্ণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার চূড়ান্ত হবে৷ তা আগামী দিনে গোটা দেশে এনআরসির ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে৷ এখন প্রশ্ন হল, তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষ কোথায় যাবে? সরকারি বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, কারও নাম এনআরসিতে না থাকলেই তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে, এমনটা নয়। বরং আইনের মাধ্যমে নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার জন্য আবেদন জানানো যাবে৷ সেজন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে৷ ট্রাইব্যুনাল যদি কোনো ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দেয়, সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টেও আবেদন করা যাবে৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরি বললেন, ‘‘দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্য নেই৷ সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্যে অহেতুক জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে৷ অবিবেচকের মতো বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ফেরৎ পাঠানোই যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হল না কেন? তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের সঙ্গে কি করা হবে? এর জবাব দিতে হবে সরকারকে৷''
১৯৫১ সালে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি হয়েছিল৷ ওই রাজ্যে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে৷ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ৪০ লাখ মানুষ৷ বার চূড়ান্ত তালিকায় ১৯ লাখ বাসিন্দার৷
বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে ভারত দেশটা ধর্মশালা নয়৷ পৃথিবীর কোনো দেশে বিদেশিদের স্থায়ীভাবে থাকতে দেওয়া হয় না। অনুপ্রবেশকারীদর মধ্যেও হিন্দু-মুসলমান কেন খোঁজা হচ্ছে, এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন৷ কেন নয়, ১৯৪৭ সালে দেশটা তো ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল৷
সায়ন্তন বসু
বরিশাল, খুলনার বহু মানুষ ধর্মীয় কারণে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ আমাদের দল ও সরকার চাইছে এনআরসির মাধ্যমে বিদেশিদের তাড়ানো হোক, অবশ্যই মুসলমানদের৷ কারণ অমুসলিমরা অত্যাচারিত৷ এটা বিজেপির সৃষ্টিলগ্নের আদর্শ৷ বাংলাদেশি মুসলমানদের বিতাড়িত করতে একদিকে যেমন এনআরসি চালু থাকবে, পাশাপাশি ২০১৪ সাল অবধি অমুসলমান শরণার্থীদের এ দেশের নাগরিকত্ব দিতে সংসদে ‘নাগরিকত্ব বিল' পাশ করানো হবে৷''
ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের মতো বৈচিত্রময় গণতান্ত্রিক দেশে কোনো সরকারের পক্ষে গায়ের জোরে এতগুলো মানুষকে বিতাড়ন করা কখনোই সম্ভব নয়৷ তা সে যে রাজনৈতিক মতাদর্শেই বিশ্বাসী সরকার হোক না কেন৷ তবে অনুপ্রবেশকারী ও এনআরসিকে রাজনৈতিক ইস্যু করে ক্ষমতায় আসা সরকার যে চিহ্নিত মানুষদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা' নিতে চাইবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ সেক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা, সরকারি পরিচয়পত্র ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত রাখার পন্থা অবলম্বন করা হতে পারে৷ কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ‘ভিনদেশী' শনাক্ত করে বলপূর্বক দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না সরকার৷
ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক কেমন?
আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে প্রথম দিকে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ সম্পর্ক বজায় রাখত ভারত৷ পরে ১৯৯২ সালে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PIB
১৯৪৭
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি এলাকা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল৷ সাধারণ পরিষদে সেটি পাসও হয়৷ তবে আরব রাষ্ট্রগুলোসহ ভারত সেই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়নি৷ ছবিতে সেই সময়কার আরব নেতাদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/United Archives
১৯৪৯
ইসরায়েলকে জাতিসংঘের সদস্য করার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত৷ তবে ডানপন্থি হিন্দু জাতীয়বাদী দল ‘হিন্দু মহাসভা’র নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সমালোচনা করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
১৯৫০
১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ভারত৷ এরপর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘‘আমরা আরও আগেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতাম, কারণ ইসরায়েল একটি বাস্তবতা৷ কিন্তু আমরা আরব রাষ্ট্রের বন্ধুদের কষ্ট দিতে চাইনি বলে, তা (ইসরায়েলকে স্বীকৃতি) করিনি৷’’
ছবি: Getty Images
১৯৫৩
মুম্বইতে ইসরায়েলের একটি কনসুলেট খোলার অনুমতি দেয় ভারত৷ কিন্তু আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে ভেবে ইসরায়েলের সঙ্গে পরিপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি নেহেরু সরকার৷
ছবি: Getty Images
১৯৬২
ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চেয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়নের (ছবি) কাছে চিঠি লিখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু৷
ছবি: Getty Images
১৯৭১
ভারতীয় পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে অস্ত্র চেয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ সেই অস্ত্র ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তি বাহিনী ব্যবহার করেছিল বলে জানায় পত্রিকাটি৷ এরপর মেয়ার গান্ধীর কাছে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন৷ তবে গান্ধী তা মেনে নেননি৷
ছবি: Getty Images/AFP/
১৯৮৫
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ সেটিই দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল৷
ছবি: picture-alliance
১৯৯২
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সময় ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েল ভারতের নতুনদিল্লিতে দূতাবাস খোলে৷ আর মে মাসে ইসরায়েলের তেল আভিভে দূতাবাস খোলে ভারত৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
১৯৯৬
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট এজার ভাইৎসমান ভারত সফরে গিয়েছিলেন৷ ইসরায়েলের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের এটিই প্রথম ভারত সফর ছিল৷
ছবি: Getty Images/GPO
১৯৯৯
কারগিল যুদ্ধের সময় ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল ইসরায়েল৷
ছবি: picture-alliance/AP/A. Rahi
২০০০
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আডভানি তেল আভিভে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট এজার ভাইৎসমানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ নিয়ে বৈঠক করেন৷ এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জসওয়ান্ত সিংয়ের সফরের সময় দুই দেশ যৌথভাবে সন্ত্রাসবিরোধী কমিশন গঠন করেছিল৷
২০০৩
ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফরে গিয়েছিলেন আরিয়েল শ্যারন৷ সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী৷
ছবি: Getty Images/AFP
২০১৪
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গিয়ে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Scheiner
২০১৫
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে ভারত৷ এর মাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিয়ে ভারতের নীতিতে পরিবর্তন আসার সংকেত দেয়া হয়৷ একই বছর ইসরায়েল সফরে যান ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xu Jinquan
২০১৭
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে যান নরেন্দ্র মোদি৷ সেখানে তিনদিন ছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PIB
২০১৭
জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ভোট দেয় ভারত৷
ছবি: picture-alliance/N. Alon
২০১৮
মোদির ইসরায়েল সফরের ছয় মাস পর ভারত সফরে যান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু৷
ছবি: AFP/Getty Images
২০১৯
প্রথম ফেব্রুয়ারি, পরে সেপ্টেম্বরে ভারত সফরে যাওয়ার কথা ছিল নেতানিয়াহুর৷ তবে দুবারই দেশে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সফর বাতিল করতে হয়েছে৷ তবে বন্ধু দিবসে একে অপরের সঙ্গে টুইটারে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন মোদি ও নেতানিয়াহু৷