1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঘৃণা ও শত্রুতার ৭০ বছর

১৪ আগস্ট ২০১৭

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান৷ কিন্তু এখনও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে রয়েছে রয়ে গেছে সীমানা বিরোধ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস৷ এখনও শুকায়নি ৭০ বছর আগের দেশভাগের ক্ষত৷

ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Sharma

সে ছিল সহিংস এক দেশভাগ৷ ১০ লাখের মতো মানুষ মারা গিয়েছিল তাতে, আরো কয়েক লাখ মানুষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল নিজের জন্মস্থান৷ নানা মত ও সংস্কৃতির ভারত উপমহাদেশকে ভাগ করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে৷ ধর্মের ভিত্তিতে, অবিশ্বাস ও অনৈক্যের যুক্তি দিয়ে জোর করে সৃষ্টি করা হয়েছিল একটি দেশ – পাকিস্তান৷

এই জন্ম যন্ত্রণা, দাঙ্গা এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট কখনও লাঘব হয়নি৷ ৭০ তম স্বাধীনতাদিবস উদযাপন করছে ভারত ও পাকিস্তান, কিন্তু ঘা রয়ে গেছে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরাতের মতোই দগদগে৷

স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিল, কোন দিকে এগোচ্ছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক৷ কাশ্মীর কার? এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় দুই দেশ৷ হিন্দু মহারাজার অধীন থেকে ‘মুক্ত' করতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহযোগীরা স্থানীয় যোদ্ধাদের পাঠান কাশ্মীরে৷ ফলশ্রুতিতে সৈন্য পাঠিয়ে কাশ্মীরের বেশিরভাগ দখলে নেয় ভারত, বাকিটা দখল করে পাকিস্তান৷ দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ হয়েছে, এবং দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের প্রধান বাধা এই কাশ্মীর বিরোধ৷ ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিয়ে একসময়কার সেক্যুলার এবং জাতিগত বিরোধকে ধর্মীয় বিরোধে রূপ দিয়েছে পাকিস্তান৷

১৯৪৮ সাল থেকেই আফগানিস্তান নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান৷ ব্রিটিশরাজ দেশটিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও প্রতিবেশীর দিকে নজর ছিল নব্য স্বাধীন দুই দেশেরই৷ দুই দেশই চাচ্ছিল অন্য দেশকে চাপে রাখতে আফগান সরকারকে প্রভাবিত করতে৷

পাকিস্তানের পশতুনরা জিন্নাহর কর্তৃত্বে বেশ নাখোশ ছিল, অন্যদিকে আফগানিস্তান ছিল পশতুন-শাসিত৷ এ কারণেই পাকিস্তানের ভয় ছিল, আফগানিস্তানে ভারতপন্থি সরকার এলে তা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ আফগান দ্বন্দ্বের শুরু সেখান থেকেই৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলের পর থেকে সে দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে৷

শুরুর বছরগুলিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও প্রভাব ফেলেছে৷ আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা, ইতিহাস, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এমনকি মনোজগতেও অবিশ্বাস ধীরে ধীরে আসন গেঁড়ে বসে৷

পশ্চিমে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ হলেও পূর্বে তেমনটা হয়নিছবি: AP

আরেক দেশভাগ!

পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিরা যখন নিজেদের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শুরুতেই তাদের ‘ভারতের দালাল' আখ্যা দেয়৷ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও ভারতের সীমান্তে অবস্থান, ভারত অংশের বাংলার এবং বাঙালি হিন্দুদের সাথে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে এই সন্দেহ আরো গভীর করে তোলে৷ পশ্চিমে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ হলেও পূর্বে তেমনটা হয়নি৷ মজার ব্যাপার হলো, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই বাংলাতেই৷ কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘুদের আইনি ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের যে স্বপ্ন জিন্নাহ দেখেছিলেন, তার উত্তরসূরিরা হাঁটলেন ঠিক তাঁর উলটো পথে৷ পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের দাবি তো মানতে অস্বীকৃতি জানালেনই, বলপ্রয়োগ করে তাদের দমনও করতে চাইলেন৷ ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ, ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷

২৪ বছরের মধ্যে এ ছিল দ্বিতীয় দেশভাগ৷ আবারও রক্তক্ষয়ী এক দেশভাগ, যাতে নিহত হয় লাখ লাখ বাঙালি৷ ধর্ষণ করা হয় হাজার হাজার নারীকে, হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের, পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়ি৷ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কখনই ক্ষমা চায়নি ইসলামাবাদ, বরং আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী করা হয় ভারতকেই৷

এই দ্বিতীয় দেশভাগও ছিল পারস্পরিক ভীতির ফল৷ জিন্নাহ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারা ১৯৪৭ সালে যে ‘শত্রু' তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, ১৯৭১ সাল তারই ফল৷

দেশভাগের স্মৃতিভ্রংশ

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যাগুলোর মূল নিহিত ১৯৪৭ সালের দেশভাগে৷উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের যে কোনো গবেষণাতেই মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ অ্যামেরিকা বা আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্য অঞ্চলেো একই ধরনের সমস্যার কথা উঠে আসবে৷ ভারতে দেশভাগ ও এর প্রভাব নিয়ে এখনও আলোচনা হয়৷ কিন্তু পাকিস্তানে এ নিয়ে নিস্তব্ধ নীরবতা, যদিও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসনকাঠামোর উন্নয়নে দেশভাগের আলোচনা এক অপরিহার্য অংশ৷

শামিল শামস, ডয়চে ভেলে

ব্রিটিশ-সমর্থিত ভূমির মালিকেরা স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রের সম্পদ ও প্রশাসনের দখল নিয়ে নেয়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে৷ তথাকথিত ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের' ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশে এখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চলছে৷ পাকিস্তানজুড়ে কেন ইসলামি জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এবং কেনই বা বিদেশ নীতি ও নিরাপত্তা নীতির ভিত্তি হিসেবে ইসলামকেই বেছে নিল, বুঝতে হলে জরুরি দেশভাগের আলোচনা৷ যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণের কথা বলছেন, তখন এই আলোচনা আরো জরুরি হয়ে পড়েছে৷

জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতার ৭০ বছর উদযাপন করছে৷ কিন্তু দুই দেশের জনগণের জন্য উদযাপনের উপলক্ষ্য তেমন কিছু নেই৷ দুই দেশই যখন নিজেদের পারমাণবিক শক্তি সামরিক ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদর্শনে ব্যস্ত, দুই দেশের জনগণের এখনও অনেক মৌলক চাহিদাই পূরণ হয় না৷ তারপরও দুই দেশের যুদ্ধবাজি চলছেই, ভারত ভাগ নিয়ে জনগণকে জানানো হচ্ছে ভুল ইতিহাস৷

স্বাধীনতার ৭০ বছর নয়, বরং একে বলা উচিত শত্রুতার ৭০ বছর৷ দেশভাগের ইতিহাস পালটানো যাবে না, কিন্তু ঘৃণার এই দেয়ালটা ভাঙা যাবে৷ চলুন, অন্তত এই দেয়ালটা ভাঙি৷

শামিল শামস/এডিকে

শামিল শামস এর মতামতটি সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ