করোনা মোকাবিলায় জার্মানির সাফল্য বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে৷ জার্মানি নিজ দেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কাজ করে এই সাফল্য পেয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
চীন, ইটালি যখন করোনা মোকাবিলায় পুরোপুরি লকডাউনে গেছে তখন জার্মানি ‘কন্টাক্ট ব্যান’ করেছে৷ মানে, জার্মানিতে অফিস-আদালত বন্ধ করা হলেও মানুষের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ না করে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল৷ আর অর্থনীতি ভালো থাকায় বন্ধ থাকাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সাধ্যমত নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে৷
বাংলাদেশের অর্থনীতি জার্মানি, চীন, ইটালি বা ইউরোপের মতো উন্নত নয়৷ ফলে সবকিছু বন্ধ করে নাগরিকদের কয়েকদিন বসিয়ে খাওয়ানো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাছাড়া ইউরোপে শিক্ষার হার বেশি হওয়ায় তাদের করোনার দোহাই দিয়ে ঘরে বন্দি রাখা সম্ভব, যেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ কারণ আমরা হচ্ছি সেই দেশের মানুষ যেখানে চাকরিতে যোগ দিতে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে, ট্রাকে করে ঢাকায় আসে, ঈদে বাড়ি যেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে, ট্রাকে থাকা তেলের পিপায় কোনোরকমে শরীর ঢুকিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আবার পাহাড়ের কোলে চড়ে বসে৷
করোনার বিরুদ্ধে কারা জেতে, কারা জেতে না
ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমানে সমানে লড়ে, কিন্তু এই লড়াইয়ে ব্রাজিল পাত্তাই পায় না৷ ৪৫ বছর আগের এক যুদ্ধের মতো পুঁচকে ভিয়েতনামের কাছে আবার লজ্জা পায় যুক্তরাষ্ট্র৷ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরো কিছু বিষয় থাকছে ছবিঘরে..
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
দেশ অপ্রস্তুত আর প্রেসিডেন্ট একগুঁয়ে হলে যা হয়
চীনে করোনা সংকট দেখা দেয়ার দু’মাস পরও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি, করোনা টেস্ট শুরু করায় বিলম্ব, ইটালিতে মৃত্যুর মিছিল দেখেও করোনাকে ট্রাম্পের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মধ্য এপ্রিলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাওয়া- ইত্যাদির উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি৷ বিশেষজ্ঞরা যা চান ট্রাম্প তার ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটতে চেয়েছেন৷ ফলাফল পরাশক্তি হয়েও করোনার কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া৷
শীতল যুদ্ধের যুগ আর নেই৷ তবে এ যুগেও কমিউনিস্ট শাসিত কিউবা আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মধুর হয়নি ৷ যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, অথচ কিউবায় মারা গেছে মাত্র ৮৩ জন৷ হোক না মাত্র এক কোটি ১৪ লাখ মানুষের দেশ, করোনাকে এভাবে বোতলবন্দি করলো কিভাবে তা-ই এখন কৌতুহলের কেন্দ্রে৷ গার্ডিয়ান বলছে, শুরু থেকে সপ্তাহের সাতদিন ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তা সম্ভব করেছে কিউবা৷
ছবি: pictrure-alliance/AP Photo/I. Francisco
বিশেষজ্ঞরা স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়লে যা হয়
লকডাউন প্রশ্নে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে কোণঠাসা হয়েছেন জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা, অ্যান্থনি ফাউচি, একই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিরোধিতা করে দায়িত্ব হারিয়েছেন ব্রাজিলের দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী৷ সামাজিক দূরত্ব মানার সরাসরি বিরোধিতা করা বলসোনারোর দেশও এখন ধুঁকছে৷ গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিউবার চেয়ে সত্তর গুন পিছিয়ে আছে ব্রাজিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
ভিয়েতনাম হলে যা হয়
ভিয়েতনামও করোনার বিরুদ্ধে দারুণ সফল৷ দেশ ছোট আর অর্থনীতি দুর্বল হলেও বড় যুদ্ধে ভিয়েতনাম কখনো হারেনি৷ ৩৫ বছর আগে সামরিক যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এখন ব্যর্থ হচ্ছে করোনা ভাইরাস৷ দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করা, অল্প সময়ে বেশি পরীক্ষা করানো, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন- সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে সফল হয়েছে ভিয়েতনাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Hau Dinh
সরকার এবং সরকারপ্রধান অপরিনামদর্শী না হলে যা হয়
জনমনে অসন্তোষ দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল ব্রাজিল সরকার৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আবার চালু হয়েছে৷ ফুটবলে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে আর্জেন্টিনা ২৬ হাজারের মতো সংক্রমণ আর মাত্র ৭৮৭ জন করোনায় মৃত্যু নিয়ে এখনো অনেক ভালো অবস্থায়৷ আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি, বিপরীতে ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির কাছাকাছি হলেও ব্যবধানটা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক বড়!
ছবি: Getty Images
করোনাকে বেশি সময় দিলে যা হয়
করোনা যখন হানা দিলো, তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জোগান- সব কিছুরই ঘাটতি ছিল ইউরোপের দেশটিতে৷ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মানতে চাননি অনেকে৷ ফলে বিপদ বেড়েছে দ্রুত৷ এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক৷ এ পর্যন্ত ইটালিতে ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ডাক্তার মারা গেছেন একশ’রও বেশি৷ বেশির ভাগ ডাক্তারই মারা গেছেন পিপিই ছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/E. Mattia Del Punta
ছোট দেশও ‘গাইডলাইন’ মানলে যা হয়
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে আর করোনায় সংক্রমিত রোগী নেই৷ বিশ্লেষকরা বলছেন মূলত গাইডলাইন মেনে চলার কারণেই এমন সাফল্য এসেছে৷ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্কুল অব ফার্মাসির শিক্ষক ওকসানা পাইসিক বলেন, ‘‘ প্রথমে খুঁজে বের করা, তারপর টেস্ট করা, আইসোলেট করা, প্রত্যেক রোগীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সংক্রমণ ধরা পড়লে কোয়ারান্টিনে পাঠানো- এসব মেনেই নিউজিল্যান্ড সফল হয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Baker
7 ছবি1 | 7
শুধু আমাদের কথাই বলছি কেন! আফ্রিকার মানুষরাও আমাদের মতো৷ তাইতো সরকারি সিদ্ধান্তে লকডাউন শুরুর পর কেনিয়ায় রাতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ পরেরদিন সে দেশের প্রখ্যাত সংবাদপত্রকে শিরোনাম দিয়ে মনে করিয়ে দিতে হয়, ‘আমরা কোনো যুদ্ধের মধ্যে নেই’৷ জাম্বিয়ায় লকডাউনের মধ্যে বারে জড়ো হওয়াদের উপর হামলা চালানো হয়, জিম্বাবোয়েতে নিয়ম না মেনে পণ্য বেচতে বাজারে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মারধর করা হয়৷
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, এক দেশে সফল হওয়া মডেল অন্য দেশে সফল নাও হতে পারে৷ তাই সমস্যা মোকাবিলার কাজ প্রত্যেক দেশকে নিজের মতো করাই ভালো৷
ইউরোপকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা বাংলাদেশে সংক্রমণের শুরুতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি৷ আর যখন সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি তখন সব খুলে দিচ্ছি৷ খুলে দেয়ার কারণ আমরা ঘরে থাকতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি৷ আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে যে দিনের পর দিন চলা সম্ভব নয় সেটা এখন প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা আমজনতা সবাই বুঝতে পারছি৷
সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্যই মার্চের শেষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখনকার সংক্রমণের সংখ্যা বলছে, সেই উদ্যোগ সফল হয়নি৷
দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার কারণে আমাদের মধ্যে এখনও এমন ভাব থেকে গেছে যে, বিদেশিরা কিছু করলে, বললে মনে হয় সেটাই সেরা৷ তাইতো দেশের কোনো বিষয় নিয়ে বিদেশিরা যতদিন পর্যন্ত না প্রশংসা করেন, ততদিন সেটাকে আমাদের ভালো মনে হয় না৷ স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা হাজারবার সেটা ভালো বললেও আমরা বিশ্বাস করিনা৷
শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সরকারের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা যায়৷ তাইতো ২০১৫ সালে দুদক যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি খুঁজে না পাওয়ার কথা জানায় তখন সরকারকে খুব বেশি খুশি হতে দেখা যায়নি৷ কিন্তু ২০১৭ সালে ক্যানাডার এক আদালত এই প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানালে সরকার সেই খবর ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করেছিল৷
দেশের ভালোর জন্য দেশের মানুষের ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করতে হবে৷ বিদেশিদের পরামর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে৷ কারণ দেশি বিশেষজ্ঞরা দেশকে চেনায় সববিষয়ের একটা ‘টেইলরমেড’ সমাধান দিতে পারবেন, বিদেশিদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়৷
আর আমাদের সাধারণ নাগরিকদেরও দেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের উপর আস্থা রাখা শুরু করতে হবে৷ কারণ তাহলেই শুধু সরকারের মধ্যে দেশি পরামর্শক দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ তৈরি হবে৷ আমাদের সবাইকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতার সেই লাইনগুলো মনে রাখতে হবে৷ তিনি লিখেছিলেনঃ
কত রূপ স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া৷
দেশপ্রেম নিয়ে লেখা কবিতার এই অংশটুকুর মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলতে চেয়েছেন, বিদেশের ভালো (ঠাকুর) কিছুর চেয়ে নিজ দেশের অল্প ভালো কিছু (কুকুর) নিয়েই গর্ব করা উচিত৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
যে পাঁচ কারণে নিউজিল্যান্ড করোনামুক্ত
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন জানিয়েছেন, তাঁর দেশে আর করোনায় সংক্রমিত রোগী নেই৷ সংক্রমিতদের সুস্থ করার পাশাপাশি সংক্রমণ বন্ধও করল কিভাবে ছোট এই দ্বীপদেশটি? ছবিঘরে জেনে নিন সাফল্যের মূল পাঁচটি কারণ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দ্রুত লকডাউন
গত ১৫ মার্চ ১০০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়লেও নিউজিল্যান্ডে তখনও এ রোগে কেউ মারা যায়নি৷ ২৫ মার্চ সীমান্ত বন্ধ করে লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী৷ সেদিন জাসিন্ডা আরদার্ন বলেছিলেন, ‘‘শুরু থেকেই কঠোর হতে হবে আমাদের৷’’ তারপর লম্বা সময় ফার্মেসি, মুদির দোকান, হাসপাতাল আর গ্যাস স্টেশন ছাড়া সব বন্ধ রাখা হয়৷ করোনামুক্ত হওয়ার পরও সীমান্ত বন্ধ রেখেছে দেশটি৷
ছবি: Imago-Images/J. Kruse
দিনে আট হাজার পরীক্ষা
এক সময় দিনে আট হাজার করে মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে৷ এভাবে মোট দুই লাখ ৯৫ হাজার মানুষের করোনা টেস্ট করানো হয়েছে মাত্র ৫০ লাখ মানুষের দেশটিতে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: picture-alliance/Zoonar
সবাইকে আস্থায় নেয়া
লকডাউন কার্যকর হয়েছে সঠিক পরিকল্পনার কারণে৷ লকডাউন ঘোষণার পরই সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব মানুষের কাছে একটি এসএমএস পাঠানো হয়৷ এসএমএসে লেখা ছিল, ‘‘এই বার্তাটি নিউজিল্যান্ডের সবার জন্য৷ আমরা আপনার ওপর নির্ভরশীল৷ রাতে আপনি যেখানে আছেন, পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হবে আপনাকে৷’’ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Colourbox
ভৌগলিক অবস্থানের সুবিধা
দ্বীপদেশ হওয়ায় সীমান্ত বন্ধ করা সহজ হয়েছে৷ বাইরে থেকে কেউ আসতে পারেনি৷ ফলে নতুন সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানো সহজে সম্ভব হয়েছে৷
গাইডলাইন মেনে চলা
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্কুল অব ফার্মাসির সিনিয়র শিক্ষক ওকসানা পাইসিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে কোনো মহামারির বিরুদ্ধে সফল হতে হলে আপনাকে প্রথমে খুঁজে বের করা, তারপর টেস্ট করা, আইসোলেট করা, প্রত্যেক রোগীর বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সংক্রমণ ধরা পড়লে প্রত্যেককে কোয়ারান্টিনে পাঠানো- এই নিয়ম মানতে হবে৷ সব দেশের জন্য কোভিড-১৯ থেকে রক্ষার এটাই সেরা উপায়৷ এটা মেনেই নিউজিল্যান্ড সফল হয়েছে৷’’