বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বুঝতে সময় লাগবে৷ এখনও বলা যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচন হবে কিনা, অর্থাৎ বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা৷ নির্বাচনকালীন সরকার হবে না, না দলীয় সরকারের অধীনেই হবে নির্বাচন৷
বিজ্ঞাপন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আশা ছেড়ে দিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন এখন নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় সরকারের কথা বলছেন৷ আর প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলছেন, যৌথ সরকারের কথা৷ এই দুই আইনজ্ঞের মতামত কাছাকাছি৷ ওদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, শেষ পর্যন্ত সংকট গিয়ে ঠেকবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবে, সেই বিষয়ে৷ যদি একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা হয়, তাহলে আর সব বিষয়ে বিএনপি ছাড় দেবে বলেই মনে করেন ড. আহমেদ৷ তবে সরকার এই বিষয়টি মানবে কিনা তা বুঝতে আরো সময় লাগবে৷ কারণ সরকারের মেয়াদ আছে ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত৷ তাই তাদের হাতে এখনও বেশ কিছুটা সময় আছে৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ড. ইমতিয়াজ বলেন, সরকারি দল যে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে তাতে ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সরকার একতরফা নির্বাচনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তাঁর মতে, আসলে বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে সরকারি দল৷ তারা দেখতে চাইছে সরকারের ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে বিএনপি৷ এটা তাদের একটি রাজনৈতিক চাল৷
অন্যদিকে, রাজনীতির সাধারণ নিয়মে বিএনপির এখন চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করার কথা৷ কিন্তু তারা তা করছে না৷ তাই ড. ইমতিয়াজ বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত মাথায় রেখেইে কাজ করছে বিএনপি৷ তাই তারা আপাতত কঠোর কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না৷ তারা অক্টোবর মাস পর্যন্ত হয়ত অপেক্ষা করবে৷ তারা যদি তখন আন্দোলন জোরদার করতে পারে, তাহলে তা প্রভাবিত করবে সরকারি দলকে৷ দেশ যদি সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায় তাহলে তা দেশের ভিতরে এবং বাইরেও চাপ সৃষ্টি করবে, যা সরকারি দলকে নতুন সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাবে, মনে করেন তিনি৷
ড. ইমতিয়াজ জানান, চলতি মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যাবেন বলে মনে হচ্ছে৷ সেখানে তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করবেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোন মারফত কথা বলে আদতে কী চেয়েছেন, তাও পড়ার চেষ্টা করবেন৷
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতার জায়গায় যাবে দুই দল৷ কিন্তু আগের চেহারার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, সেটা হবে সমঝোতার সরকার৷