এই নিয়ে একটানা ১৫ বছর ধরে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস৷ এ বছর জাতিসংঘের থিম: ভাষার সঙ্গে ও মাধ্যমে ‘ইনক্লুসিভ’ শিক্ষা৷ ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরও বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংগঠন ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ২০০৭ সালের ১৬ই মে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সদস্য রাষ্ট্রগুলির উদ্দেশ্যে সব ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার আহ্বান জানায়৷ চলতি বছর থিম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘ভাষার সঙ্গে ও মাধ্যমে ইনক্লুসিভ, অর্থাৎ সামুদায়িক শিক্ষা' – এই ভাবনাকে৷
ঢাকায় যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে প্রতি বছর এই দিনটি পালিত হয়৷ এ বছর ভাষা শহিদদের স্মরণে ‘অমর একুশের' অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এদিন সন্ধ্যায়ই তিনি কলকাতায় ফিরে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি ভাষা শহিদ স্মারক উদ্বোধন করবেন৷ উল্লেখ্য, বর্তমানে কলকাতায় আরও দুটি ভাষা স্মারক রয়েছে৷
ভারতের কেন্দ্রীয় মধ্যশিক্ষা বোর্ড বা সিবিএসই তাদের অনুমোদিত সব স্কুলে এ দিন ‘মাতৃভাষা দিবস' উদযাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে৷ ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া'-য় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশেষ করে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলেও ছাত্রছাত্রীরা তাদের মাতৃভাষা ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ব্যবহারে আরও উৎসাহ দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ তবে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষার ঠিক আগে এমন উদ্যোগ নিয়ে সংশয় পরীক্ষা করেছে বেশ কিছু স্কুল৷
বিভিন্ন দেশে নানাভাবে উদযাপিত হচ্ছে দিনটি৷ যেমন ক্যানাডার টোরন্টো শহরে দুই বাংলার অনেক মানুষ বসবাস করেন৷ শহরের ‘বিচ মেট্রো কমিউনিটি'-র ওয়েবসাইটে ক্রিসেন্ট টাউন এলাকার আজিম দেওয়ানের একটি উদ্যোগ তুলে ধরা হয়েছে৷ তিনি টেলর ক্রিক পার্ক-এ একটি ভাষা শহিদ স্মারক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন৷ আগামী বছরই এটি প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি৷
আ-মরি বাংলা ভাষা
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি৷ মায়ের ভাষার জন্য শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে৷ তাঁদের আত্মদানে বাংলা আজ আমাদের রাষ্ট্রভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ইতিহাসের শুরু
১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে৷ জেগে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজ৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ ছাত্রজনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ করে৷ শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও আরো অনেকে৷
ছবি: DW
শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন৷ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নামে হাজারো মানুষের ঢল৷ ভোরে খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে অংশ নেন সব শ্রেণির মানুষ৷ সব পথ গিয়ে মেলে এক পথে – কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে৷ জাতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্মরণ করছে শহীদদের৷
ছবি: picture-alliance/AP
প্রভাত ফেরির গান
২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার অন্যতম সাক্ষী আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী৷ রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী৷ তিনি শহীদ রফিকের মরদেহ দেখার পরই এই গানটির প্রথম লাইন তাঁর মাথায় এসেছিল – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’৷ যেটি এখন প্রভাত ফেরির গান হয়ে গেছে৷ এ গানের সুরকার ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ৷
ছবি: DW
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’
২১শে ফেব্রুয়ারির সেই ঘটনায় বাঙালি বুঝতে পেরেছিল, তারা আসল স্বাধীনতা পায়নি৷ তাই ভাষা স্বাধীনতা, তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তখন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র৷ যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আব্দুল লতিফের গানে, ‘‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়''৷ অতুল প্রসাদ সেন লেখেন ‘মোদের গরব মোদের আশা’৷
ছবি: picture-alliance/AP
বাংলাদেশের জন্ম
বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একুশের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পূর্ণতা পায় একাত্তরের স্বাধিকারের লড়াইয়ে৷ বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো-র প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনেকেই যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে৷
ছবি: AP
বাংলা ভাষায় পরিবর্তন
সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – এর যুগ থেকে শুরু করে বা বঙ্কিমের ভাষা যেরকম প্রমথ চৌধুরীর আমলে পরিবর্তিত হয়ে অনেকটা কথ্য ভাষায় রূপ নিয়েছিল, তেমনি আজকের বাংলা ভাষা অনেকটাই গণভাষায় পরিণত হয়েছে৷ নব প্রযুক্তির যেসব শব্দ রয়েছে, তা বাংলা ভাষা খুব দ্রুত আহরণ করেছে৷ দ্রুত আহরণের ফলে ঢুকে পড়ছে অবাঞ্ছিত শব্দও৷
ছবি: DW/M. Mamun
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে৷ এবার অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও আয়োজন করা হয়েছে মেলার৷ এবারের মেলা উত্সর্গ করা হয়েছে প্রয়াত ভাষা সৈনিক সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে৷