‘দোষ’ যার চাকরি তার, ‘নির্দোষ’ পায় না প্রতিকার?
৯ জানুয়ারি ২০২৫তাদের পাসিং প্যারেডের তারিখ ছিল ২০ অক্টোবর। সব প্রস্তুতি শেষ। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো দেড় হাজার অতিথিকে। একদিন আগে সারদায় গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে আগের রাতেই স্থগিত করা হয় প্যারেড।
‘অপরাধ' যখন এলোমেলো হাঁটা
পাসিং প্যারেডের পরবর্তী তারিখ ঠিক করা হয় ২৪ নভেম্বর। তার আগে আবার স্থগিত হয় প্যারেড। এমনটি ঘটেছে বিসিএস ৪০ ব্যাচের এসপিদের সঙ্গে। ওই ব্যাচের ৬৬ জনের মধ্যে ২৫ জনকে এখন ‘শো-কজ' করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা প্যারেডে দৌড় না দিয়ে এলোমেলো হেঁটেছেন। আবার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ মুভি দেখার সময় হৈ চৈ করার।
অবাক করা ব্যাপার হলো, এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে দুই দফা পাসিং প্যারেড স্থগিত হওয়ার পর। কিন্তু তারা এখনো সারদায় আছেন। শো-কজ নোটিস পাওয়া ২৫ জন এএসপি এখন চাকরি হারানোর শঙ্কায়।
জানা গেছে, চাকরিতে যোগ দেয়ার আগে তাদের সব ধরনের পুলিশ ভেরিফিকেশন হলেও প্যারেড স্থগিত করার পর জেলার এসপিদের মাধ্যমে তাদের ব্যাপারে আবার তদন্ত করা হয়। তদন্তে কোনো ধরনের সমস্যা না পাওয়ার কারণেই হাস্যকর কারণ দেখিয়ে তাদের শো-কজ করা হয়। এলোমেলো হাঁটা এবং মুভি দেখার সময় হৈ চৈ করার কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন এমন কয়েকজন এএসপির দাবি, এলোমেলোভাবে হাঁটা বা মুভি দেখার সময় হৈ চৈ-এর ঘটনা পুরোই কাল্পনিক। তারা্ বলছেন, প্রথমবার প্যারেড স্থগিত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ যাতে কোনো অজুহাত তৈরি করতে না সেবিষয়ে অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন৷
৪০ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয় ২০১৮ সালে। চার বছরের সব পরীক্ষা ও প্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ৪০তম বিসিএসের এক হাজার ৯২৯ জন কর্মকর্তার নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালায়। ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর সবাই চাকরিতে যোগ দেন। লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিএটিসি) ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে পুলিশ বাদে প্রশাসনসহ বাকি সব ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখন চাকরি করছেন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সময় এক হাজার ৯২৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে এএসপি ছাড়া সবাই কর্মক্ষেত্রেই ছিলেন। চাকরিরতদের চাকরি এখন স্থায়ী হবার পথে। কিন্তু অভিযোগ তোলা হচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর এএসপিদের মৌলিক প্রশিক্ষণ শুরু হয় সারদা পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে। পুলিশের নিয়ম ও রীতি অনুযায়ী, এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর তাদের পাসিং প্যারেড হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় তিন মাস ধরে কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না তারা। আটকা পড়েছেন সারদায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এএসপি কান্নাজড়িত কণ্ঠে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ঘটনায় আমাদের পরিবার চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। একটি গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছে আমাদের বিরুদ্ধে। সবাই জানে আমরা এএসপি হয়েছি। এখন যদি আমাদের বাদ দেয়া হয়, তাহলে আমাদের ক্যারিয়ার কেথায় গিয়ে দঁড়াবে?”
তিনি আরো বলেন, "আমাদের চাকরিতে নিয়োগের আগে এবং পরে দুইবার পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে। ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়েছে৷ শো-কজের পর আবার করা হয়েছে। তাতেও কোনো ত্রুটি না পেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে এখন কাল্পনিক অভিযোগ করা হচ্ছে।”
যে ২৫ জনের বিষয়ে এখন তদন্ত চলছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের মধ্যে তিন জন নারী।
আরেকজন এএসপি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একজন সমন্বয়ক পোস্ট দিয়ে সবাইকে ফ্যাসিস্ট বানিয়ে দিলো। ৬৬ জনের মধ্যে ৬২ জনকে ছাত্রলীগের ক্যডার বললো আর সরকার সেটা মেনে নিলো- এটা কীভাবে হয়! আমরা তো ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কোনো দায়ত্বিও পালন করিনি। আমরা তো সারদায় ট্রেনিংয়ে ছিলাম তখন।”
এই এএসপিদের স্বজনরা ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পুলিশের আইজির কাছে ন্যায় বিচার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। পুলিশের আইজি বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করেছেন, তবে সফল হতে পারেননি। স্বজনদের একজন বলেন," আমরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আমাদের সন্তানদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কোনো অপরাধ ছাড়াই তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা এটা বন্ধ করে আমাদের সন্তানদের চাকরিতে যোগ দিতে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
খাবার খেতে না চাওয়ার অপরাধ
এর আগে তিন দফায় সারদায় প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ৩২১জন সাব ইন্সপেক্টরকে বাদ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- খাবার খেতে চাননি, ক্লাস ও ডাইনিং রুমে হৈ চৈ করেছেন। বাদপড়া ওই সাব ইন্সপেক্টররা তাদের চাকরিতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের আইজি বরাবর আবেদন করেও ফল পাননি। গত ১৭ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেছেন তারা। আদালত সরকারের ওপর রুল জারি করেছে। বাদপড়া সাব ইন্সপেক্টর নাজির হোসেন বলেন, "আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার ভিতরে সত্যের লেশ মাত্র নেই। আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা করিনি। আমাদের একজন প্রশিক্ষকও বিবৃতি দিয়ে তা বলেছেন। আমাদের আসলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।”
পুলিশের সাবেক এসপি আনসার উদ্দিন খান পাঠানের দাবি বিগত সরকারের আমলে তিনি অন্যায়ের স্বীকার হয়েছেন৷ সেই কারণে একই পরিস্থিতি এখন দেখতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, "আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকার পরও আওয়ামী লীগ আমলে আমাকে ২২ বার সুপারসিড করা হয়। এসপির পর আর পদোন্নতি পাইনি। পরে ১৮ বছর চাকরি করে অবসরে যাই। সেই পরিস্থিতি যদি এখনো থাকে, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।”
তার কথা, "যাদের শো-কজ করা হয়েছে বা চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, তারা আওয়ামী পরিবারের বা তারা ছাত্রলীগ করতো। কিন্তু সেটা তারা কাগজ-পত্রে বলতে পারছে না বা দেখাতে পারছে না। তাই তারা এখন বাজে কিছু কারণ দেখাচ্ছে। তারা নাকি এলোমেলো দৌড় দিয়েছে, ডাইনিং রুমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। আসলে এগুলো কোনো কারণ বলে আমার কাছে মনে হয় না। তাদের ব্যাপারে এখন পুরো বিষয়টি রিভিউ করে দেখা উচিত। তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা ঠিক হবে না।”
তিনি আরো বলেন, "তারা যদি পুলিশে শুদ্ধি অভিযান চালাতে চায়, তাহলে পুলিশে কারা অপরাধ করেছে, সেটা তো সবার জানা। যারা পলিটিক্যাল বক্তব্য দিয়েছে, গুম, খুনের সঙ্গে জড়িত, যারা ভোটারবিহীন নির্বাচনে সহায়তা করেছে, তাদের ধরুক। এই নিরীহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কেন? তারা তো ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দায়িত্বও পালন করেনি, তারা তো তখন সারদায় ট্রেনিংয়ে ছিল। আর সবচয়ে বড় কথা, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করলে তো আর এই সমস্যা হবে না। সরকার সেটা করুক।”
‘আমার ক্লাসে আদৌ ওই ধরনের ঘটনা ঘটেনি'
সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির সাবেক প্রিন্সিপাল ও পুলিশের সাবেক অ্যাডিশনাল আইজি নজিবুর রহমান এখনো পুলিশ অ্যাকাডেমিতে পড়ান। তিনি বলেন, "সাব-ইন্সপেক্টরদের বিরুদ্ধে আমার একটি ক্লাসে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু আমার ক্লাসে আদৌ ওই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তারা কীভাবে ওই অভিযোগ তৈরি করলো তা আমি বুঝতে পারছি না।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "প্রশিক্ষণের সময় বা পাসিং প্যারেডের সময় কোনো অপরাধ করলে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও এখন যেটা করা হচ্ছে, তা নজীরবিহীন। আমি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল ছিলাম। কখনো এভাবে গণহারে এসআইদের বাদ দেয়া, এএসপিদের শোকজ করার ঘটনা দেখিনি। আমরা মনে হয় কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পরে।”
আর এএসপিদের শো-কজ করার ব্যাপারে সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল অ্যাডিশনাল আইজি মো. মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া জানান, "তাদের শোকজ করা হয়েছি কিনা সে ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নাই। তারা সবাই প্রশিক্ষণে আছেন।”
প্রতিবেদকের কাছে শো-কজের কপি থাকার কথা জানালে তিনি আবারও বলেন, "আমার কাছে কোনো তথ্য নাই।” এসআইদের ব্যাপারে বলেন, "যা করা হয়েছে নিয়মের মধ্যেই করা হয়েছে।”
অন্যদিকে ৪৩ তম বিসিএসের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০জনসহ ২৬৭ জনকে বাদ দিয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এরপর থেকে বাদ পড়া প্রার্থীরা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন। নিয়োগের দাবিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দেন তারা। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) দুপুরে ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়াদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেসুর রহমান বলেন, "৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়া ২৬৭ জনের মধ্যে বেশিরভাগই পুনরায় চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন। তাদের পুনর্বিবেচনার আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। তদন্ত শেষ। দ্রুত সময়ে এটা করা হবে।''
তিনি বলেন, "ফৌজদারি অপরাধ, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিল অথবা এমন কোনো হিডেন অপরাধ সে করেছে যেটা সামনে আসছে- এরা ছাড়া অন্যদের নিয়োগ প্রাপ্তিতে শুধু একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তারা এটি পাবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শোকজ পাওয়া এক এএসপি বলেন, "আমাদের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে আবার ওই তিনটি বিষয়: ফৌজদারী মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেকে বহিস্কৃত হয়েছি কিনা তার রেকর্ড দেখতে পারে। আমাদের তিন ধাপের পরীক্ষার প্রাপ্ত নাম্বারও যাচাই করে দেখতে পারে। কিন্তু যেসব হাস্যকর অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলেও অ্যাকডেমির ম্যানুয়াল মতে তাতে আমাদের শাস্তি হলো ‘এক্সট্রা ড্রিল' করা। তারপরও আমাদের যদি বাদ দেয়া হয়, তাহলে তা হবে অন্যায় এবং অমানবিক।”
জনপ্রশাসন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সিনিয়র সাংবাদিক শরিফুল হাসান বলেন, "আসলে নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থাকা উচিত না। এখন এএসপি, সাব-ইন্সপেক্টদর নিয়ে যা করা হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ছাত্রলীগ, গোপালগঞ্জ বা হিন্দু বলে যে ধরণের প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেটা খুবই দুঃখজনক।”
তার কথা, "এর আগে আবার ছাত্রদল বা শিবির বলে প্রচারণা চালানো হতো। এসবের অবসান হওয়া প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, "৪০তম বিসিএসের এএসপিদের বার বার পাসিং প্যারেড স্থগিত করার মধ্য দিয়ে তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। এটা অন্যায়। তাদের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের অফিসাররা তো এখন চাকরি করছেন। তারা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দায়িত্বও পালন করেছেন। আর এএসপিরা তো তখন দায়িত্বে ছিলেন না, তারা ছিলেন ট্রেনিংয়ে, তাহলে তাদের কী অপরাধ? ৩২১ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে অসত্য অজুহাতে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হলো। তারাও তো ট্রেনিংয়ে ছিলেন। ৪৩ বিসিএসের ২৬৭ জনের মধ্যে ৪০ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাননি। বকি ২২৭ জন কী দোষ করেছেন, তাদের কেন বাদ দেয়া হলো? এইসব ঘটনা, যে উদ্দেশ্য নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার চেতনা-বিরোধী।”