সেই ১৯৮৯ সালে দেশ ছেড়ে জার্মানিতে আসেন শিব শংকর পাল৷ ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধে জিতেছেন সফলভাবেই৷ সম্প্রতি মিউনিখ পৌর কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়েছেন ‘সফল অভিবাসী উদ্যোক্তা'-র স্বীকৃতি৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের উন্নত ও সমৃদ্ধশালী শহরগুলোর একটি জার্মানির মিউনিখ শহর৷ বাভেরিয়ার রাজ্যের রাজধানী মিউনিখের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই অভিবাসী৷ নগর উন্নয়নে অভিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বিবেচনা করে এখানকার পৌর কর্তৃপক্ষ অভিবাসী উদ্যোক্তাদের পুরষ্কৃত করতে ২০১০ সাল থেকে চালু করে ‘ফিনিক্স পুরস্কার'৷ প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার জিতলেন একজন বাংলাদেশি৷
ডয়চে ভেলের সাথে কথোপকথনকালে শিব শংকর পাল বলেন, ‘‘এখন তো অনেকেই এসে সরাসরি চাকরি করতে পারে৷ কিন্তু আমাদের সেই সময়ে এটা খুব কঠিন ছিল৷ আমি এখানে প্রথমে এসে আমার সার্টিফিকেটগুলোকে ‘একনলেজ' করানোর৷ কিন্তু হয়নি সেটা৷ আমাকে কেবল ‘আবিটুর' (জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক সমমানের পরীক্ষা) পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছিল৷'' হতাশ না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে আসা শিব শংকর বৈদ্যুতিক ব্যবসায় প্রয়োজনীয় পড়াশুনা করে গড়ে তোলেন ‘পাউলইলেক্ট্রো' নামের একটি প্রতিষ্ঠান৷
বাংলাদেশি ‘কুইন্স ইয়াং লিডার অ্যাওয়ার্ড’ বিজয়ীরা
২০১৪ সালে কমনওয়েল্থভুক্ত দেশগুলোর ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কুইন্স ইয়াং লিডার’ পুরস্কার চালু করে যুক্তরাজ্য সরকার৷ ছবিঘরে থাকছে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের কথা৷
ছবি: privat
‘কুইন্স ইয়ং লিডার’ পুরস্কার
মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখছেন যেসব তরুণ, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কমনওয়েল্থভুক্ত দেশগুলোর ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি সেই তরুণদের জন্য ‘কুইন্স ইয়ং লিডার’ পুরস্কারটি চালু করে যুক্তরাজ্য৷ রানির ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয় এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান এবং ২০১৮ সালে শেষবারের মতো প্রদান করা হবে এই স্বীকৃতি৷
ছবি: picture-alliance/PA Wire
সামির শিহাব, ২০১৫
সামির শিহাব ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল ইনিশিয়েটিভ’ (বিওয়াইইআই) নামে একটি উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি৷ জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও পরিবেশ নীতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত ও টেকসই উন্নয়ন – এ সব বিষয় নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার পান তিনি৷ বর্তমানে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে দ্বিতীয় মাস্টার্স করছেন তিনি৷
ছবি: privat
ওসামা বিন নূর, ২০১৬
ওসামা তাঁর বন্ধু মানিককে নিয়ে শুরু করেন ‘ইয়ুথ অপরচুনিটিস’, যা একটি বৃহত্তর সুযোগ আবিষ্কারের প্লাটফর্ম৷ মূলত তরুণদের জন্য সুন্দর আগামী গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন তাঁরা৷ ১৯২টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় ৬ লাখেরও বেশি তরুণ কাজের সুযোগ খুঁজতে ভিজিট করেন ওয়েবসাইটি৷ এছাড়া ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা ওসামা রেডিওতে তরুণদের জন্য ‘তিন টেক্কা’ নামের একটি অনুষ্ঠানও সঞ্চালনা করেন৷
ছবি: privat
রাহাত হোসাইন, ২০১৭
‘ক্রিটিকালিং’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন রাহাত হোসেন৷ তিনি এর প্রোগ্রাম পরিচালক৷ দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয় প্রতিষ্ঠানটি৷ তাঁদের প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার তরুণ৷
ছবি: privat
সাজিদ ইকবাল, ২০১৭
‘চেঞ্জ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ ইকবাল৷ পরিবেশ রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার সাজিদের কাজের মূল লক্ষ্য৷ তাঁর প্রতিষ্ঠান সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছিল ‘বোতলবাতি’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে৷ দিনের বেলায় বস্তির অন্ধকার ঘরে সূর্যের আলো ব্যবহার করে তৈরি করা যায় এই বোতলবাতি৷
ছবি: privat
আয়মান সাদিক, ২০১৮
‘টেন মিনিট স্কুল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আয়মান বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন৷ এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়৷ আয়মান এবং তাঁর দলের অপর ৫২ জন সদস্য মিলে এই স্কুলগুলো পরিচালনা করছেন৷
ছবি: privat
জায়বা তাহিয়া, ২০১৮
জায়বা ‘ফিমেল এমপাওয়ারমেন্ট মুভমেন্ট’ বা ফেম-এর প্রতিষ্ঠাতা৷ সহিংসতা রোধে বাংলাদেশে নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো এবং সমাজে নারী-পুরুষ সমতা আনতে কাজ করে যাচ্ছেন৷ যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিদ্যায় ডিগ্রি নেয়া জায়বা স্বল্প আয়ের নারীদের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থন করার কৌশল এবং বাইসাইকেল চালানোর নিয়ম শেখান৷ আয়মান এবং জায়বা আগামী বছর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে এ সম্মাননা গ্রহণ করতে যাবেন৷
ছবি: privat
7 ছবি1 | 7
বাংলাদেশের শিব শংকরের পাশাপাশি এবার মিউনিখের ফিনিক্স পুরষ্কার পেয়েছেন ফ্রান্স, ইটালি, গ্রিস ও পোল্যান্ড থেকে আসা আরো চার অভিবাসী৷ ডিসেম্বরের ৫ তারিখ তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন শহরের মেয়র৷
শিব শংকর গত ২৮ বছর ধরে বাস করছেন জার্মানিতে৷ স্ত্রী ও তিনসন্তান আর সেই সাথে নিজের ব্যবসা – এ সব নিয়ে ব্যস্ত জীবনের দৌড়ের পাশাপাশি মাঠেও দৌড়ান শিব শংকর৷ নিজস্ব এই নেশার ঘোরে নিয়মিত দৌড়ে অংশ নেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়৷ এ পর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক ম্যারাথনে অংশ নেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ দু-তিন দিন না দৌড়ালে মনে হয় কী যেন করা হয়নি৷ দৌড় আমাকে বাঁচিয়ে রাখে৷''
যেসব তরুণ হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিপথে পা বাড়ায়, তাদের জন্যও তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের কোনো অবলম্বন থাকলে মানুষ সহজে হতাশ হয় না৷'' ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এ স্বীকৃতি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে৷ অভিবাসী হিসেবে প্রতিকূলতার বাঁধাও টপকাতে হয়েছে অনেক৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশিদের দেশের বাইরে বিভিন্ন নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ায় অনেক সময় ভিন্ন ধরনের অবিশ্বাসের মুখোমুখিও হতে হয় তাঁকে৷ ‘‘অনেকেই মনে করেন, সন্ত্রাসী সব তৈরি হয় কেবল আমাদের ঐ দেশগুলোতে-বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশে৷'' তবে সবাই মিলে চেষ্টা করলে এ ধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, একজন প্রকৃত দৌড়বিদের মতোই এমন আশার কথাও জানান সেই সাথে৷
শিব শংকর পালকে কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচের ঘরে৷ আপনার শুভেচ্ছা আমরা তাঁর কাছে পৌঁছে দেবো৷