৭০ বছর আগে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল৷ সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে জার্মানি কীভাবে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে, সেই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করে তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে ডয়চে ভেলে৷
বিজ্ঞাপন
১৯৪৫ সালের ৮ই মে৷ ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে৷ প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ জার্মানির মানুষ পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করছে, যদিও অনেকে প্রায় ৬ বছরের যুদ্ধে বাবা, ভাই ও ছেলের মৃত্যুর পর যুদ্ধের সমাপ্তির ফলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে৷ বছরের পর বছর ধরে বোমাবর্ষণ বন্ধ হওয়ায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শহরবাসীরা আবার বুকভরা নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে৷ তবে জার্মানির বেশিরভাগ মানুষের কাছে সেটা ছিল পরাজয়ের দিন৷ বিশেষ করে সৈন্যদের জন্য, যারা বন্দিশিবিরে বসে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার অপেক্ষায় ছিল৷ কিছু সৈন্য দ্রুত মুক্তি পেয়েছিল৷ অন্যদের প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত সোভিয়েত বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়৷ মিত্রশক্তি, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ক্যানাডা ও বেলজিয়ামের কাছে ৮ই মে শর্তহীন আত্মসমর্পণের দিন, জয়ের দিন৷ যারা ‘তৃতীয় রাইশ'-এর নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, তাদের কাছেও দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে৷ ইহুদি, সমকামী, সিন্টি ও রোমা জনগোষ্ঠী, কমিউনিস্ট, সামাজিক গণতন্ত্রী, উদারপন্থি, খোলামেলা ও গোপন হিটলার-বিরোধীদের জন্য সেটা ছিল মুক্তি দিবস৷
মনোভাবের আমূল পরিবর্তন
১৯৮৫ সালের ৮ই মে৷ রিশার্ড ফন ভাইৎসেকার প্রকাশ্যে এমন কথা বললেন, যা অনেকেই অনুভব করেছেন অথবা জানতেন৷ এর আগে কোনো জার্মান প্রেসিডেন্টের মুখে এমন কথা শোনা যায়নি৷ তিনি বলেন, ৮ই মে ছিল পরাজয়ের দিন৷ কিন্তু বাস্তবে দিনটি ছিল মুক্তির দিবস৷ নাৎসি স্বৈরাচারী, আডলফ হিটলারের কবল থেকে জার্মানরা মুক্তি পেয়েছিল৷ তারা সেটা চেয়েছিল কিনা, সেটা অন্য প্রশ্ন৷ ইহুদি-নিধনের আতঙ্ক থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল৷ ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছিল৷ যুদ্ধের সমাপ্তি হত্যালীলাও বন্ধ করেছিল – যুদ্ধক্ষেত্রে এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে৷ জার্মানি পরাজিত হয়েছিল বটে, কিন্তু হিটলারকে ঘিরে বর্বরতা ও দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে কয়েক বছর পরেই আবার মুক্তি ও গণতন্ত্রের জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিল৷ কমপক্ষে পশ্চিমে তা সম্ভব হয়েছিল৷ কারণ পূবে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র – জিডিআর-এর পত্তন ঘটে৷ তারা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ‘ভ্রাতৃরাষ্ট্র'৷ গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তির সুযোগ সেখানে ছিল না৷ ১৯৯০ সালে আবার দুই জার্মান রাষ্ট্রের একত্রীকরণের পর সেখানকার মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পায়৷
নতুন আত্মসচেতনতা
৮ই মে ২০১৫৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৭০ বছর কেটে গেছে৷ আজ পুনরেকত্রিত জার্মানি বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত রাষ্ট্রগুলির অন্যতম৷ একদিকে গণতন্ত্র, অন্যদিকে সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা৷ আবার একই সঙ্গে বিপুল অর্থনৈতিক সাফল্য৷ সামাজিক মডেল হিসেবে গোটা বিশ্বে যা আকর্ষণীয়৷ জার্মানি এটাও বুঝতে শিখেছে, যে গত এক দশক ধরে সবাই তাদের উপর লক্ষ্য রাখছে; তার গুরুত্ব বাড়ছে; ইউরোপে তার নেতৃত্বের ভূমিকা ও গোটা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের প্রত্যাশাও বাড়ছে৷ তবে সামরিক ক্ষেত্রে ততটা নয়, যদিও তারও গুরুত্ব রয়েছে৷ মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই জার্মানির বিশেষ অবস্থান আশা করা হচ্ছে৷ জার্মানি মোটেই পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে না৷ তবে দেশ হিসেবে জার্মানির আত্মসচেতনতা বাড়ছে৷ এবং তার জন্য যে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে, তা ঐকমত্যে অভ্যস্ত জার্মানদের জন্য বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা৷ তবে তাদের এমন অবস্থা মেনে নিতে শিখতে হবে৷
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷