দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন লুণ্ঠিত হয় প্রখ্যাত ফরাসি চিত্রকর কামি পিসারোর আঁকা কয়েকটি ছবি৷ এর মধ্যে সন্ধান পাওয়া একটি ছবি তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্যারিসের একটি আদালত৷
বিজ্ঞাপন
এ বছরের শুরুর দিকে প্যারিসের মারমোতঁ জাদুঘরে উনিশ শতকের বিখ্যাত চিত্রকর কামি পিসারোর আঁকা ছবি ‘লা কিয়েৎ দে পোয়া' বা ‘পি হারভেস্ট' প্রদর্শিত হয়৷ মার্কিন দম্পতি ব্রুস ও রোবি টল তাঁদের সংগ্রহে থাকা ছবিটি প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে জাদুঘরে দিয়েছিলেন৷ আর সেখানেই তা নজরে পরে ফ্রান্সের ব্যবসায়ী সিমোঁ বাউয়ার৷ ১৯৪৩ সালে যে সম্ভ্রান্ত ইহুদি আর্ট কালেক্টর পরিবারের কাছ থেকে ছবিটি নাৎসিরা লুট করে, সিমোঁ বাউয়ার তাঁদেরই বংশধর৷ ছবিটি প্রদর্শনীতে দেখেই এর স্বত্ব দাবি করে মামলা করেন সিমোঁ বাউয়ার৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দম্পতি ১৯৯৫ সালে নিলামে ৮ লক্ষ ডলার দিয়ে ছবিটি কিনেছিলেন৷ আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী, ছবিটির এ হাত বদল অবৈধ আর তা ফেরত দিতে হবে মূল মালিকের কাছে৷ এমনকি যে অর্থ দিয়ে তাঁরা ছবিটি কিনেছিলেন তা ফেরত দেয়ার আদেশের বদলে উলটে এ দম্পতিকেই ৮ হাজার ইউরো আদালতে জমা দিতে বলা হয়েছে৷ তবে মার্কিন দম্পতি এর বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানান তাদের আইনজীবী৷ ‘‘আমার মক্কেল ছবিটি উদ্ধার করতে না পারলে খুবই হতাশ হবেন৷ ছবিটি তাঁদের খুবই পছন্দ৷ তাঁরা নিশ্চয় এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন৷''
আলোচিত কয়েকটি শিল্পকর্ম চুরির কথা
২০১৭ সালের মার্চে জার্মানির বার্লিনের একটি মিউজিয়াম থেকে ১০০ কেজি ওজনের একটি স্বর্ণমুদ্রা চুরি হয়৷ ছবিঘরে থাকছে মূল্যবান কয়েকটি শিল্পকর্ম চুরির কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. K. Techt
মোনালিসার হাসি হারিয়ে গিয়েছিল
১৯১১ সালে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পোর্ট্রেট লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ চুরি হয়ে গিয়েছিল৷ ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া নামের ইটালির এক তরুণ মিউজিয়ামের কর্মীর পোশাক পরে নিজের কোটের মধ্যে পেইন্টিংটি লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷ ১৯১৩ সালে পুলিশ এটি উদ্ধার করে৷
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
সবচেয়ে বেশি চুরি হওয়া পেইন্টিং
ডাচ শিল্পী রেমব্রেন্ডট-এর আঁকা পোর্ট্রেট ‘জ্যাক থ্রি ডি গাইন’ ব্রিটেনের ডালউইচ পিকচার গ্যালারি থেকে এক বার, দু’বার নয়, চার বার চুরি হয়েছে৷ ১৯৬৬ সালে প্রথম বার চুরির পর ১৯৭৩, ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালেও চুরি হয়েছিল এই পোর্ট্রেট৷ তবে ভাগ্য ভালো যে প্রতিবারই এটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
পুলিশের বেশে চুরি
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের ইসাবেলা স্টুয়ার্ড গার্ডনার মিউজিয়াম থেকে একসঙ্গে ১৩টি পেইন্টিং চুরি হয়ে যায়৷ দুই ব্যক্তি পুলিশের বেশে ঢুকে সেগুলো চুরি করেন৷ ছবিতে যেটি দেখতে পাচ্ছেন, তার নাম ‘কনসার্ট’৷ চুরি যাওয়া পেইন্টিংগুলোর মধ্যে এটিও ছিল৷ আজও মিউজিয়ামে চুরি যাওয়া পেইন্টিংগুলোর ফ্রেম খালি অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Gemeinfrei
ফান গখের শিল্পকর্ম চুরি
১৯৯১ সালে আমস্টারডামের ফান গখ মিউজিয়াম থেকে ২০টি পেইন্টিং চুরি হয়ে গিয়েছিল৷ অবশ্য মাত্র ঘণ্টাখানেক পরেই সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল৷ তবে চোরদের ধরতে কয়েক মাস লেগে যায়৷ এক ব্যক্তি প্রথমে নিজেকে মিউজিয়ামের একটি বাথরুমে আটকে রেখেছিলেন৷ পরে একজন প্রহরীর সহায়তায় সেগুলো চুরি করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Van Weel
নিরাপত্তা প্রহরীকে পরাভূত করে
২০০৩ সালে দুই ব্যক্তি স্কটল্যান্ডের ড্রামলানরিগ ক্যাসেলের প্রহরীদের পরাস্ত করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘ম্যাডোনা অফ দ্য ইয়ার্নউইন্ডার’ নিয়ে যায়৷ ঐ শিল্পকর্মের দাম ছিল প্রায় ৭০ মিলিয়ন ইউরো৷ প্রায় চার বছর পর ২০০৭ সালে গ্লাসগো থেকে এটি উদ্ধার করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউজিয়ামে সশস্ত্র হামলা
এক্সপ্রেশনিস্ট এডভার্ড মুঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’ ও ‘ম্যাডোনা’ নামের দুটি পেইন্টিং ২০০৪ সালে অসলোর মুঙ্ক মিউজিয়াম থেকে নিয়ে গিয়েছিল দুই সশস্ত্র ডাকাত৷ অস্ত্রের মুখে তারা দর্শণার্থীদের সামনে থেকেই পেইন্টিং দুটি নিয়ে গিয়েছিল৷ পুলিশ পরে সেগুলো উদ্ধার করতে পারলেও ‘দ্য স্ক্রিম’ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে পরে সেটি আর সম্পূর্ণ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Munch Museum Oslo
ইউরোপের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম চুরির ঘটনা
২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখের ব্যুরলে মিউজিয়াম থেকে চারটি পেইন্টিং চুরি গিয়েছিল৷ পেইন্টিংগুলোর মোট মূল্য ছিল ১৮২ মিলিয়ন ডলার৷ ছবিতে ক্লোদ মনে’র ‘পপি ফিল্ড নেয়ার ভিথেই’ দেখতে পাচ্ছেন৷ চুরি যাওয়া পেইন্টিংয়ের তালিকায় এটিও ছিল৷ পরে সবগুলোই উদ্ধার করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
স্বর্ণমুদ্রা চুরি
১০০ কেজি ওজনের এই মুদ্রা চুরি গেছে বার্লিনের বডে মিউজিয়াম থেকে৷ ২০১৭ সালের মার্চে এটি চুরি হয়েছে৷ ‘বিগ ম্যাপল লিফ’ নামে ক্যানাডায় তৈরি এই মুদ্রার উপাদানগত মূল্য প্রায় চার মিলিয়ন ডলার৷ ৫৩ সেন্টিমিটার উঁচু ও ৩ সেন্টিমিটার পুরু এই মুদ্রার সামনের অংশে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি রয়েছে৷ জানালা দিয়ে চোর মিউজিয়ামে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F.May
8 ছবি1 | 8
অন্যদিকে, বাউয়ার পরিবার আদালতের এ সিদ্ধান্তকে ‘স্বাভাবিক' বলে মনে করেন৷ বাউয়ার-এর পিতামহ ছিলেন জুতার ব্যবসায়ী৷ নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথে সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন তিনি৷ যুদ্ধ শেষে ১৯৪৭ সালে মৃত্যু হয় তাঁর৷
২০১১ সালে জার্মানির মিউনিখ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল শত শত অমূল্য পেইন্টিং যেগুলো নাৎসি বাহিনী বিভিন্ন সময়ে লুট করেছিল৷ ছবিগুলো বর্তমানে বন শহরে ‘গুরলিট কালেকশন' নামে প্রদর্শিত হচ্ছে৷
একনায়ক হিসেবে সারা বিশ্বে কুখ্যাতি অর্জন শুরুর আগে হিটলার ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী৷ ‘ফ্যুহরার’ যেসব শিল্পকর্মকে ঘৃণা করতেন, সেগুলোর ভাগ্যে ‘পতিত শিল্পকর্ম’-র তকমা জুটতো এবং জাদুঘর থেকে তা সরিয়ে ফেলা হতো৷
ছবি: Bundesarchiv, Bild 183-C10110/CC-BY-SA
‘পতিত’ শিল্প
মডার্ন আর্ট-এর ধরন, এর শিল্পী বা বিষয়বস্তু হিটলারের একেবারেই পছন্দ ছিল না, তাই নাৎসিরা একে বলতো ‘পতিত শিল্পকর্ম’৷ ১৯৩৭ সাল থেকে নাৎসিরা জার্মানির জাদুঘর থেকে এসব শিল্পকর্ম সরিয়ে দিয়েছিল৷ এই ছবিতে হিটলার এবং সেসময়কার প্রচারণা মন্ত্রী গোয়েবেলসকে মিউনিখের একটি জাদুঘরের প্রদর্শনীতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিটলারের শিল্পকর্ম
রোমান্টিকতা এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পকর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল হিটলারের৷ তিনি পছন্দ করতেন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য৷ তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাই ছিল ক্রানাখ, টিনটোরেটো এবং বোর্ডোনের ছবি৷ আর তার অনুসরণীয় ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাভেরিয়ার লুদভিগ আই এবং ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট৷ অবসরের পর নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর ইচ্ছে ছিল হিটলারের৷ নিৎস শহরে ফ্যুহরার জাদুঘরে প্রদর্শনী আয়োজনের ইচ্ছা ছিল তার৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection/Actual Films
বাজেয়াপ্ত
নাৎসিরা কেবল প্রগতিশীল শিল্পীদের নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা জাদুঘরে তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল৷ ১৯৩৭ সালে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ১০১ টি জার্মান জাদুঘর থেকে ২০ হাজার শিল্পকর্ম সরিয়ে ফেলে কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Victoria & Alber Museum
হিটলারের জাতীয়তাবাদী ধরন
হিটলারের জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনায় বিমূর্ত শিল্পের যে কোনো স্থান নেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ১৯৩৭ সালের ১৮ই জুলাই মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘গ্রেট জার্মান আর্ট’ প্রদর্শনীতে৷ সেখানে চিরাচরিত প্রাকৃতিক দৃশ্য, ইতিহাস এবং নগ্ন চিত্রকর্মের প্রদর্শন হয়েছিল, এর বাইরে বিমূর্ত কোনো শিল্পকর্ম ছিল না৷
ছবি: Bundesarchiv, Bild 183-C10110/CC-BY-SA
‘পতিত শিল্প’ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ
কখনো কখনো হিটলারের ঘনিষ্টজনরাও নিশ্চিত হতে পারতো না, কোন শিল্পীর কাজ হিটলার অনুমোদন দেবেন৷ তবে, আধুনিক কালের সৃজনশীল শিল্পী মাক্স বেকমান, ওটো ডিক্স, আর্নেস্ট লুদভিগ ক্রিসনারের কাজের অনুমোদন দেননি তিনি৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
পতিত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী
‘পতিত শিল্পকর্ম’ নামের প্রদর্শনীতে ৩২ টি জার্মান জাদুঘর থেকে বাজেয়াপ্ত করা ৬৫০ টি শিল্পকর্মের প্রদর্শন হয়েছিল৷ সেখানে মানসিক প্রতিবন্ধীদের আঁকা স্কেচও স্থান পেয়েছে৷ বিভিন্ন শহরে এটির প্রদর্শন হয়, যা দেখেছিল ২০ লাখ মানুষ৷
ছবি: cc-by-sa/Bundesarchiv
নিষেধাজ্ঞা যখন বৈধতা পেল
১৯৩৮ সালের ৩১ শে মে ‘পতিত শিল্পকর্ম বাজেয়াপ্ত’ আইন প্রণয়ন করা হয়, যার মাধ্যমে ঐ শিল্পকর্মে নিষেধাজ্ঞা আরোপকে বৈধতা দেয়া হয়৷ যুদ্ধপরবর্তী কালেও ঐ আইনটি কার্যকর ছিল৷
ছবি: CC by Österreichische Nationalbibliothek
পতিত শিল্পকর্ম পোড়ানো
বাজেয়াপ্ত হওয়া শিল্পকর্মগুলো বার্লিনের গুদামঘর এবং শ্যোনহাউজেন প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ ১৯৩৯ সালের ২০শে মার্চ বার্লিনের অগ্নি নির্বাপন বিভাগ ৫০০০ শিল্প নির্দশন পুড়িয়ে ফেলে, যেটা তারা ‘মহড়ার’ অংশ বলে চালিয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
সুইজারল্যান্ডে নিলাম
১৯৩৯ সালের ৩০শে জুন সুইজারল্যান্ডে নিলামের সময় ১২৫টি ‘পতিত শিল্পকর্ম’ চিহ্নিত হয়েছিল, যা বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়৷