যাঁরা দ্বৈত নাগরিকত্বের বিরোধিতা করেন, তাঁরা বলেন যে এটা গণতন্ত্রের বিরোধী৷ কিন্তু ডয়চে ভেলের সোরান আরবুটিনা বলছেন, এটা এক ধরনের সস্তা প্রচারণা, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নয়৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে৷ এর বিরোধীরা বলে থাকেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে নাগরিকরা দুই দেশের জন্য সমানভাবে ভাবতে বা কাজ করতে পারে না৷ তাই এক্ষেত্রে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়৷ বলা বাহুল্য, দ্বৈত নাগরিকত্বের বিরোধীরা বরাবরই আতঙ্ক তৈরিতে ব্যস্ত৷ এটা যেন এক ধরনের স্বৈরশাসন৷ তাঁরা দ্বৈত পার্সপোর্টধারীদের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে মনে করেন৷
তবে এই বিরোধ যাঁরা মার্কিন বংশোদ্ভূত জার্মান এবং ট্রাম্পের সমর্থক, তাঁদের নিয়ে নয়৷ ফরাসি-জার্মানদের মধ্যে যাঁরা মারিন ল্য পেন বা ‘ন্যাশানাল ফ্রন্ট'-এর সমর্থক, তাঁদের নিয়েও নয়৷ এমনকি ৬ লাখ ৯০ হাজার ডানপন্থি পোলিশ-জার্মান বা কাসিনস্কি-ভক্ত অথবা ৫ লাখ ৭০ হাজার রুশ-জার্মান যাঁরা পুটিনকে পছন্দ করেন, তাঁদের নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷ মূল সমস্যা হলো ৫ লাখ ৩০ হাজার তুর্কি-জার্মানদের নিয়ে, যাঁরা এর্দোয়ানকে সমর্থন করে৷
যেভাবে এর্দোয়ানের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে তুরস্কের মানুষ
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের রাতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় নামতে অনুরোধ করেছিলেন৷ আর তখন থেকেই রাস্তা দখলে রেখেছে তাঁর সমর্থকরা৷ আংকারা থেকে জানাচ্ছেন ডিয়েগো কুপোলো৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘এর্দোয়ান আমাদের কমান্ডার’
তারা প্রতিরাতে গাড়ি চালিয়ে আংকারার ‘ডেমোক্রেসি ওয়াচ’ ব়্যালিতে হাজির হন৷ ব়্যালিতে অনেকের মতো হাজির ছিলেন ২১ বছর বয়সি জয়নিপ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান যতদিন চাইবেন ততদিন আমি তাঁর প্রতি সমর্থন জানানো অব্যাহত রাখবো৷ তিনি আমাদের ‘কমান্ডার ইন চিফ’৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
অটল, তবে সহজ সমর্থন নয়
‘‘যদি দরকার হয় তাহলে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে হলেও ব়্যালিতে থাকবো’’, বলেন ৩১ বছর বয়সি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিত৷ তুরস্কের মতো একটি উদ্বায়ী রাষ্ট্র শুধু এর্দোয়ানের পক্ষেই চালানো সম্ভব, মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/D. Cupolo
স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটানোয় এর্দোয়ানের প্রশংসা
যখন জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি এর্দোয়ানের সমর্থক, তখন ২১ বছর বয়সি পাবলিক ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী কামেল কায়া জানান, এর্দোয়ানের একেপি পার্টি তুরস্কের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষেবার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘(এর্দোয়ান) ক্ষমতায় আসার আগে হাসপাতালগুলোর খুব করুণ দশা ছিল৷ তিনি সেগুলোর সংস্কার এবং সামগ্রিক অবস্থা ভালো করেছেন৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
‘রাজনৈতিক ইসলামের’ জন্য চাপ
২২ বছর বয়সি ইসমাইল জানান, তিনি এর্দোয়ানকে সমর্থন দিচ্ছেন কেননা তিনি তুরস্কের সরকারকে দেশটির সমাজের ইসলামিক শেকড়ের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কোনো সংবিধান চাই না, তবে আমরা এমন একটি চাই যেখানে ইসলামের জন্য আরো জায়গা থাকবে৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এর্দোয়ানের সমর্থকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা
ব়্যালিতে আগতদের বিনামূল্যে খাবার, পানি এবং পরিবহন সেবা দেয়া হয়, জানান তুরস্কের কুর্দিপন্থি এইচডিপি পার্টির চেয়ার সেলাহাতিন দিমিত্রাস৷ তিনি বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এর্দোয়ানের সমর্থকদের পানি এবং খাবর দিয়ে স্বাগত জানানো হয়৷ আর দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আমার লোকেরা প্রতিবাদ করে তখন তাদের দিকে জলকামান ছোড়া হয়৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এর্দোয়ানের চোখে রাষ্ট্রের শত্রু গুলেন
ফেতুল্লাহ গুলেনের একটি প্রতিকৃতি এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ব়্যালিতে৷ সেটির বুকের উপরে লেখা: ‘‘ফেতু: তোমার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতা৷’’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকা তুরস্কের ধর্মীয় নেতা গুলেনের বিরুদ্ধে এর্দোয়ানকে হঠাতে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে৷ প্রতিক্রিয়ায় গুলেনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে এর্দোয়ান৷
ছবি: DW/D. Cupolo
গ্রেপ্তার চলছেই
তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এখনও পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষকে আটক, গ্রেপ্তার অথবা চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে৷ এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে যে, তারা ন্যয়বিচার পাবে৷ এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে ৩৪ বছর বয়সি শাহিন বলেন, ‘‘ইউরোপ আমাদের সমাজ নিয়ে শঙ্কিত৷ কেননা তারা জানে, আমরা শীঘ্রই বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে৷ আর এ জন্যই তারা আমাদের সমালোচনা করে৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
7 ছবি1 | 7
তাঁকে নিয়েই এ মুহূর্তে মেতে আছে জার্মানি৷ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার রেশ ধরে জার্মানদের একটা বড় অংশ মনে করে যে, ইউরোপের গণতন্ত্রের জন্য এর্দোয়ান হুমকিসরূপ এবং তাঁকে সবার ভয় পাওয়া উচিত৷ আর শুধু তাঁকেই নয়, তাঁর বাহিনী বা সমর্থক, অর্থাৎ তুর্কি-জার্মানদের থেকেও দূরে থাকা ভালো৷
অথচ বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব বৈধ৷ যার অর্থ, ইইউ নাগরিকদের এ থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়৷
অবশ্য তুর্কি-জার্মানদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা বা আলোচনার প্রধান কারণ তুর্কিরাই৷ এই যেমন, ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জার্মানির ৪৩ লাখ মানুষের দু'টি পাসপোর্ট আছে৷ এরা প্রধানত জার্মানির নাগরিক, তবে পাশাপাশি অন্য আর একটি দেশেরও নাগরিক৷ দেখা যাচ্ছে, এঁদের মধ্যে ৫ লাখ তুর্কি৷ এর বাইরে ১৫ লাখ তুর্কি জার্মানিতে জার্মান পাসপোর্ট ছাড়াই বসবাস করছে৷ বাকি ৮ লাখ তুর্কির কেবলমাত্র জার্মান পাসপোর্ট রয়েছে৷ অর্থাৎ শতকরা মাত্র ২০ ভাগ তুর্কির দু'টি পাসপোর্ট রয়েছে৷ তাহলে এ অবস্থা জার্মানির গণতন্ত্রের জন্য কীভাবে হুমকি হয়ে উঠবে?
দু'সপ্তাহ আগে কোলনে এর্দোয়ান সমর্থকদের সমাবেশের পরই এই আলোচনাকে উসকে দিয়েছে জার্মানরা৷ ঐ সমাবেশে ৩০ থেকে ৪০ হাজার তুর্কি যোগ দিয়েছিল৷ আর সেই ৪০ হাজার তুর্কির যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব থেকে থাকে, তাতে জার্মানির গণতন্ত্রের কি এমন ক্ষতি হবে?
আসলে জার্মানিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেই মূলত এই প্রশ্নগুলো উঠছে৷ ভিন্ন ভাষাভাষি, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের কাছে স্বস্তির জায়গাটা হলো দ্বৈত নাগরিকত্ব৷ কিন্তু সেটা পাওয়া না গেলে, অর্থাৎ কাউকে যদি শুধুমাত্র জার্মান নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তার মানে এই নয় যে, তাঁকে জোর করে জার্মানিকে ভালোবাসতে হবে৷ নিজের দেশপ্রেমকে বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখাতে হবে৷ দ্বৈত নাগরিকত্ব পেলেও কাউকে জোর করা যাবে না জার্মানির একজন হয়ে ওঠার জন্য৷ আমার তো মনে হয়, তুমি জোর করে কাউকে ধর্ষণ হয়ত করতে পারো, কিন্তু ভালোবাসা পেতে পারো না৷
আধুনিক গণতন্ত্রের মতবাদ হলো মুক্ত সমাজ৷ নাগরিকরা মুক্তভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারলে, সেটাই হবে গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ৷ আর সেজন্য যদি দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রয়োজন হয়, তবে তা দেওয়া হবে না কেন?
বন্ধু, আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷
শরণার্থী সংকট নিরসনে তুরস্ককে ম্যার্কেলের আশ্বাস
তুরস্ক সফর করলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তাঁর সঙ্গে বৈঠকে তুরস্ককে ইইউ-র সদস্য করার দাবি তুলে ধরেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী৷ জার্মান চ্যান্সেলর তাতে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, শরণার্থী সংকট নিরসনে পারস্পরিক সহযোগিতা খুব প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/O. Berg
আঙ্কারায় ম্যার্কেল
ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্রোত নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলুর সঙ্গে বৈঠক করতে রবিবার আঙ্কারায় যান ম্যার্কেল৷ বৈঠকে শরণার্থী ইস্যু নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে৷ নিজের বক্তব্যে ম্যার্কেল তুরস্কের ইইউ সদস্য হওয়ার দাবিকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন৷ তুরস্কের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবিও বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি৷
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ২০ লক্ষ সিরীয়কে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক৷ জার্মান চ্যান্সেলরের বক্তব্যে এই বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়ায় এবং জার্মানি এই সংকটে তুরস্কের পাশে থাকবে জানানোয় আহমেদ দাভুতোগলু জানান, ‘‘(শরণার্থীর) চাপ ভাগাভাগির বেলায় আন্তর্জাতিক মহল দুঃখজনকভাবে তুরস্ককে একা ফেলে রেখেছিল৷ আগের চেয়ে ভালো দৃষ্টিভঙ্গি দেখে আমরা খুশি৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
তুরস্ক প্রসঙ্গে ইইউ-র সাম্প্রতিক অবস্থান
ম্যার্কেলের সঙ্গে বৈঠকে দাভিতোগ্লু যে দু’টি বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, সেগুলো ইতিমধ্যে ইইউ বৈঠকেও আলোচিত হয়েছে৷ তুরস্কে অবস্থানরত সিরীয়দের জন্য তুর্কি সরকারকে ৩ বিলিয়ন ইউরোর অর্থ সহায়তা দেয়া এবং ইইউ অঞ্চলে তুর্কিদের ভিসা প্রাপ্তি সহজ করার সিদ্ধান্ত ইউরোপের ২৮টি দেশের জোট মোটামুটি চূড়ান্ত করেছে বলেই জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/K. Ntantamis
জার্মানিতে অভিবাসীবিরোধীতা
ইতিমধ্যে ব্যাপক শরণার্থীর ঢল নামায় জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ কয়েকজন সরকার এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ৷ শরনার্থীবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ নতুন করে শুরু করছে পেগিডা৷ এদিকে শনিবার কোলনের মেয়র প্রার্থী হেনরিয়েটে রেকার-এর ওপর হামলা হয়৷ ছুরির আঘাতে আহত হলেও তিনি এখন সুস্থ হওয়ার পথে৷ প্রথম নারী হিসেবে কোলনের মেয়রও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি৷ অভিবাসীবিরাধী সংগঠন পেগিডা এই হামলায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে৷