1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, মন্ত্রী বলছেন ‘অপেক্ষা করুন'

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২

দিন দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, বাড়ছে না আয়৷ সংসারের খরচ সামাল দিতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন৷ মন্ত্রী বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷

ছবি: DW

একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম৷ সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি করে মাস শেষে কেটেকুটে বেতন পান ৬০ হাজার টাকা৷ ১৮ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দেন৷ বিদ্যুৎ বিলসহ বাসার খরচ এসে দাঁড়ায় ২০ হাজারের মতো৷ প্রতিমাসে গ্রামের বাড়িতে থাকা বয়স্ক বাবা-মায়ের খরচ বাবদ দেন ১০ হাজার টাকা৷ দুইটা বাচ্চা আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার৷ এই চারজন মানুষের খাওয়ার খরচ কোনভাবেই ১৮ হাজার টাকার কমে হয় না৷ নিজের অফিসে আসা-যাওয়া খরচ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা৷ বাকী ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে নিজেদের মোবাইল খরচ, চিকিৎসা, ইন্টারনেট, ডিশ কানেকশন, পোশাক, বাচ্চাদের খেলনাসহ আরও অনেক কিছুই আছে৷ এর বাইরে আত্মীয়-স্বজন কেউ বাসায় এলে শুধু খাওয়ার খরচই অনেক টাকা বেড়ে যায়৷ শুক্রবার মিরপুরের শেওড়াপাড়া কাঁচাবাজারে কথা হচ্ছিল এই ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে৷

ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে মি. রফিকুল বলেন, ‘‘খরচের যে হিসাব আপনাকে বললাম, এর মধ্যে কী বাদ দেব? ফলে খাওয়ার খরচই কমাতে হয়৷ কিন্তু এখন জিনিসপত্রের যে দাম তাতে তিন বেলা ডাল-ভাত খাওয়াও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে৷ এখন আমি নিম্নবিত্ত না মধ্যবিত্ত কিছুই বুঝতে পারছি না৷ তারপরও অফিস থেকে ফেরার পথে কখনও টিসিবির ট্রাক সামনে পেলে তেল আর ডাল কিনে নিয়ে আসি৷ আবার সহকর্মী বা আত্মীয় স্বজনের কেউ যদি দেখে ফেলে টিসিবির ট্রাকে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছি, সেটাও তো লজ্জার৷ এখন আসলে আমাদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাই কঠিন৷''

এতো গেল একজন ব্যাংক কর্মকর্তার গল্প৷ যিনি বেতন পান ৬০ হাজার টাকা৷ এই বেতন তো এখন অনেক! এর থেকে কম বেতন পান বহু মানুষ, যাদের এখনও আমরা মধ্যবিত্ত বলছি৷ বছরের শুরু থেকে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে৷ এখন যে পর্যায়ে ঠেকেছে তাতে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বললে ভুল হবে না৷ ঠিক দেড় মাস পরেই শুরু হবে রোজা৷ ফলে তখন পরিস্থিতি কী হবে সেটা ভাবাও কঠিন৷ দিন চলতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ৷

ব্যবসায়িরা তো আর বেশি টাকা দিয়ে পণ্য কিনে কম টাকায় বিক্রি করবে না: টিপু মুনশি

This browser does not support the audio element.

সরকারি বিপণন সংস্থা (টিসিবি) প্রতিদিন প্রকাশ করে বাজারদরের তালিকা৷ শুক্রবার পণ্যের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেল, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৮টির দামই বেড়েছে৷ এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, পেঁয়াজ, মুরগি, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিনি, ডিম, জিরা ইত্যাদি৷ চার দিন আগে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা৷ শুক্রবার সেটা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা৷ ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিনের লিটারে আট টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়৷ বাজারে এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়৷ কয়েক মাস স্থির থাকার পর আবার বেড়েছে চিনির দাম৷ এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছিল ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা৷ এখন সেটা ৮০-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ ডিমের ডজন এখন ১১০ টাকা৷

অসহনীয় হয়ে উঠা ভোগ্যপণ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এখানে তো বাড়বেই৷ খোঁজ নিয়ে দেখেন এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কত ছিল, আর এখন কত? ব্যবসায়িরা তো আর বেশি টাকা দিয়ে পণ্য কিনে কম টাকায় বিক্রি করবে না৷ এখন আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার অপেক্ষা করতে হবে৷ পাশাপাশি আমরা টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করছি৷ সেটা দেওয়া গেলেও অন্তত ৫ কোটি মানুষ কম মূল্যে পণ্য পাবেন৷''

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও কিছু পণ্যের দাম বাড়বে, এটা সত্যি৷ কিন্তু যে পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, বাজারে কোন ঘাটতি নেই সেটার দাম কেন বাড়বে? কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি ৯৫ লাখ টন৷ আমন ও আউশ মৌসুমে ফলন হয়েছে ভালো৷ বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিও করা হয়েছে চাল৷ খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুতও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে৷ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের মজুত ছিল ১৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিকটন৷ এরপরও দামে কেন বাড়ছে? বাজারে মোটা চালের দাম এখন ৫০ টাকা৷ প্রতি কেজি মিনেকেট চাল ৬৪-৬৫ এবং নাজিরশাইল ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷

জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনোমিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের তো চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে, তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কথা না৷ তেলের দাম না হয় বুঝলাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বেড়েছে? আসলে আমাদের ৫০-৬০টি চালকল এত বড় তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ এটাকে আমি সিন্ডিকেট বলব না৷ ধানের বড় একটা অংশ তারা ভাঙায়, ফলে তারা যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে সেটাতেই বিক্রি হচ্ছে৷ এখানে সরকারকে ভুমিকা রাখতে হবে৷ কতিপয় মানুষের কাছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তারা তো মুনাফা করতে চাইবেই৷ পাশাপাশি তেলে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে৷'' এর সঙ্গে টিসিবির সক্ষমতা বাড়িয়ে আরও বেশি পণ্য দিয়ে তাদের মাঠে নামানোর কথাও বলছেন এই অর্থনীতিবিদ৷

চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে, তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কথা না: ড. নাজনীন আহমেদ

This browser does not support the audio element.

এমন পরিস্থিতিতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় শুরু হচ্ছে রমজান মাস৷ রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকার আগে থেকেই নড়েচড়ে বসেছে৷ তাই দেড় মাস আগেই ১২ সংস্থাকে মাঠে নামানো হচ্ছে৷ সরকারের এই সংস্থাগুলো আমদানি থেকে শুরু করে খুচরা, পাইকারি বাজার ও পণ্য পরিবহন এই চার স্তরে নজরদারি করবে, যাতে রমজানকে পুঁজি করে কেউ অতি মুনাফা করে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে৷ এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলা হচ্ছে৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম বাজার তদারকি করবে৷ পাশাপাশি এই কার্যক্রমে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাবের সদস্যরা সহায়তা করবে৷

‘‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের গা দেয়ালে ঠেকে গেছে৷ কিন্তু সরকার শুধু তার পেটুক বাহিনীর চিন্তা করছে৷ দরিদ্র মানুষের ব্যাথা বুঝতে পারছে না৷'' এমন মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম৷ শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন৷ তিনি বলেন, আমি নিজে দেখেছি, খাবারের অভাবে মানুষ বাজারে ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু কিনতে পারছে না৷ খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরছে৷ কারণ তাদের কেনার সামর্থ্য নেই৷ এগুলো এখন সরকার দেখে না৷  আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের কথা বলে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে৷ কিন্তু বাইরে কমার পরে তখন আর দেশে কমে না৷ কেরোসিনের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজারে কম, তাহলে কেন দেশে কমাচ্ছেন না!

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে৷ যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে৷ নতুবা সরকার শুনবে না৷ আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না৷ জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয়দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য৷ সরকার হয়তো তাই-ই করবে৷ সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না৷ কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে৷ সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে৷ সরকার চাইলেই টিসিবির পরিধিও আরও বাড়াতে পারে, কিন্তু সেটাও তারা করছে না৷''

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী নতুন বছরের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন৷ গত জানুয়ারিতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ৷ গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ৷

টিসিবির মুখপাত্র হমায়ুন কবির বলেছেন, বাজারের তুলনায় টিসিবির পণ্যের মান ভালো৷ দামের পাশাপাশি এ কারণেও লাইন বড় হচ্ছে৷ আবার এই সুযোগে একটি চক্র একাধিকবার লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে৷ তারা আবার সেসব খোলা বাজারে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি৷ এসব প্রতারকদের ঠেকাতে বাড়তি জনবল টিসিবির নেই৷ সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে৷ শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি ও ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে৷

গত বছরের ছবিঘর

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ