ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার আরও কমিয়ে সম্প্রতি যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সরাসরি সুফল এবার দেখা যাচ্ছে ইউরোপের অর্থনীতি জগতেও৷ পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বেড়ে চলেছে প্রত্যাশাও৷
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার রেকর্ড মাত্রায় কমানোর ফলে পুঁজিবাজার বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে৷ বন্ড বাজারেও গতি এসেছে৷ অর্থাৎ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে ইসিবি-র দাওয়াই বেশ কাজ করছে৷ সুদের নিম্ন হারের ফলে বিনিয়োগ বেড়ে যাচ্ছে৷ মার্কিন ডলারের তুলনায় ইউরো-র বিনিময় মূল্যও অনেক কমে গেছে, যা ইউরোপ থেকে রপ্তানির জন্য সহায়ক হতে পারে৷ তবে প্রায় তিন দিন একটানা উন্নতির পর মঙ্গলবার পুঁজিবাজার আবার কিছুটা থমকে গিয়েছিল৷
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপের অর্থনীতি জগতের জন্য এই প্রবণতা কতটা স্থিতিশীল? ইসিবি-র প্রধান মারিও দ্রাগি আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের শুরু থেকেই বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছেন৷ ফলে ইসিবি-র পদক্ষেপ ও মন্তব্য বাজারকে বার বার শান্ত করেছে, ইউরোপের প্রতি আস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে৷ কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছে ইউরোপের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিয়ে৷ বাজার যে রকম স্পষ্ট, ধারাবাহিক নীতি দেখতে চায়, প্রত্যাশা অনুযায়ী সেটা ঘটছে না৷ তার উপর গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইইউ-বিরোধী ভোটের মাত্রার কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে চাঙ্গা করতে যে কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সদস্য দেশগুলির নীতির মধ্যে যে সমন্বয়ের প্রয়োজন, শীর্ষ নেতারা সেই সব পদক্ষেপ নিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে৷ এখনো পর্যন্ত তাঁরা অবশ্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন৷ যেমন আর্থিক উদ্ধার তহবিল গঠন, জাতীয় স্তরে আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে আরও কড়া নিয়ম চালু করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করা ইত্যাদি৷ আসলে তাঁরা কিছুটা উভয় সংকটে পড়েছেন৷ একদিকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং জনসমর্থন নিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ অন্যদিকে কাঠামোগত নীতির রূপায়ণ করতে হলে ব্রাসেলস-এর হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দিতে হয়৷ এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনাই মূল চ্যালেঞ্জ৷
২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চ্যালেঞ্জ
ইইউ অঞ্চলের বিদ্যমান সংকট নিরসনে নতুন বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে৷ ছবিঘরে সেসব বিষয় সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নির্মাণাধীন ভবন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে৷ গড়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন৷ ভবন নির্মাণের সময় প্রচুর শব্দ হয়, ধুলাও হয় প্রচুর৷ আর্থিক দিকটা দেখে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আর নির্মাণ শ্রমিকরা নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেন, আশপাশের এলাকাবাসীর সব রকমের ঝামেলাই মেনে নিতে হয়৷
ছবি: DW
ইউরোপীয়দের আছে বিকল্প
চলমান সংকটের সময় ইইউ-র নানা কর্মসূচিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কর্মসূচির কার্যকারীতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে৷ মে মাসে অনুষ্ঠেয় ইউরোপীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব দেখা যেতে পারে৷ গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমছিল৷ কিন্তু এবার ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছে ইইউ পার্লামেন্ট৷ এমনকি টেলিভিশনে বিতর্কের মাধ্যমেও অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images
ইউরোপীয় বিস্ময়?
ইইউ-র সংশয়বাদী অংশগুলো নিজেদের ভোট বাড়ানো জন্য উঠেপড়ে লেগেছে৷ ব্রিটেনের ইউকে ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিংবা জার্মানির অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচলান্ড – সবাই চায় ‘স্বল্প ইউরোপ’৷ প্রশ্ন হলো, তারা কি একটি স্থিতিশীল প্যান-ইউরোপিয়ান জোট গড়তে পারবে?
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
সংকট ব্যাবস্থাপনা
কয়েক বিলিয়ন বেইলআউট সংকটাপন্ন ইউরোপে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছে৷ আর্থিক অনুদান এবং সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে আয়ারল্যান্ড ইইউ-র বিশেষ অর্থায়নের সহায়তা ছাড়াই চলতে পারছে৷ অন্য দেশগুলোতেও কৃচ্ছতা সাধন এবং আর্থিক সংস্কার কর্মসূচিতে কঠোরতা আসার অপেক্ষায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংকট নিরসনে অলৌকিকের সহায়তা?
সংকট নিরসনের আগে কারণটা জানতে হয়৷ ইইউ অঞ্চলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা চলছে৷ যেসব ব্যাংকের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাদের কখনোই দেশের অর্থনৈতিক সংকট চরমে তোলার মতো পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয়, নাগরিকদের উচিত নয় করের টাকায় ব্যাংকগুলোকে বেইলআউটের দিকে এগিয়ে দেয়া৷ প্রস্তাবিত ব্যাংকিং ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে ইইউকে আগেই হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চাকুরি প্রত্যাশীদের জন্য সুখবর
ইইউ অঞ্চলের ২ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি বেকারের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হতে পারে৷ অতীতে সংকটের সময় কর্মহীনদের কাজ দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা না করায় কঠোর আর্থিক পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সমালোচনা হয়েছে৷ এবার ব্রাসেলস থেকে সাহায্যের হাত বাড়ানো হবে, সংকটাপন্ন দেশগুলোর তরুণদের সহায়তা করবে ইইউ-র বিভিন্ন কর্মসূচি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চাই আরো প্রতিযোগিতার মনোভাব
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ইইউ অঞ্চলের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে৷ এ লক্ষ্যে উন্মুক্ত অভ্যন্তরীণ বাজার এবং তৃতীয় দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার কথা ভাবছে ইউরোপীয় কমিশন৷ এছাড়া ইইউ-র সংকটগ্রস্ত সদস্য দেশগুলোকে নিজ নিজ সমস্যা সমাধানে অবশ্যই আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে৷
ছবি: Getty Images
তথ্য নিরাপত্তা ২.০
ইইউ অঞ্চলে দু’বছর পর্যন্ত সবার টেলিফোন এবং ইন্টারনেট তথ্যের রেকর্ড রাখা আইনসম্মত৷ তবে এক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে৷ ইউরোপীয় কোর্ট অফ জাস্টিস এ বছরের শুরুতেই তথ্য ধারণ সংক্রান্ত আইনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে৷ বিচারকদের অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে তথ্য ধারণ করে রাখলে মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়৷ তাই তথ্য ধারণ সংক্রান্ত প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: CC-BY-Verena Hornung 3.0
অভিবাসন নীতিমালা
ইইউ অঞ্চলে শরণার্থী এবং রাজনৈতিক আশ্রয় বিষয়ক নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ ২০১৩ সালের অক্টোবরে ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় এসে ৩৬০ জন আফ্রিকান অভিবাসী ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরার পর, ইইউ-র অভিবাসন নীতিমালা পড়েছে তোপের মুখে৷ নতুন বছরে ইইউ তাই অভিবাসন প্রত্যাশীদের মূল দেশ এবং ট্র্যানজিট দেশের সঙ্গে সহযোগীতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হবে৷ এক্ষেত্রে উল্লেখিত দেশগুলোকে আরো বেশি উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার কথাও ভাবছে ইইউ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
এই প্রেক্ষাপটে সংকটগ্রস্ত দেশগুলির ভূমিকাও চোখে পড়ার মতো৷ যে সব দেশকে বেলআউট নিতে হয়েছিল, গ্রিস ও সাইপ্রাস ছাড়া বাকি সবাই আবার পুরোপুরি আর্থিক বাজারে প্রবেশ করতে পেরেছে৷ গ্রিসও পাঁচ বছরের বন্ড বাজারে ছেড়েছে৷ সংস্কার ও বাজেট সামলানোর পদক্ষেপের কারণেও বাজারে এই সব দেশের প্রতি আস্থা বাড়ছে৷ শুধু বেকারত্বের মোকাবিলার ক্ষেত্রে কিছু দেশ অগ্রগতি দেখাতে পারছে না৷ বিশেষ করে স্পেন ও গ্রিসের পরিস্থিতি সবচেয়ে কঠিন৷ তাছাড়া এই সব দেশের বিপুল ঋণভার ধীরে ধীরে কমাতে হবে৷ অন্যদিকে বেলআউট-এর প্রয়োজন না হলেও ফ্রান্স ও ইটালিতে সংস্কারের অভাবের কারণে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা৷ ইটালি কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু ফ্রান্সের অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷