শিল্পোন্নত জি ২০ দেশের লোকেরা যে ধরনের খাবার, যতটা পরিমাণে খান, বাকি বিশ্বও তা শুরু করলে আরও অন্তত সাতটা পৃথিবী লাগবে সেই খাবার যোগান দিতে।
বিজ্ঞাপন
সব চেয়ে বড় অপরাধী হলো অ্যামেরিকা ও জার্মানি। সঙ্গে আছে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডার মতো দেশগুলি। ব্যতিক্রম ভারত এবং ইন্দোনেশিয়া। পরিবেশ বাঁচানোর জন্য প্যারিস ক্লাইমেট মিট-এ খাবার সংক্রান্ত কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া বাদে বাকি জি ২০ দেশগুলি থেকে অনেক বেশি কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। এর জন্য দায়ী খুব বেশি পরিমাণে রেড মিট ও দুধজাত জিনিস খাওয়া।
নরওয়ের অলাভজনক সংস্থা ইট-এর রিপোর্ট 'দ্য ডায়েট ফর আ বেটার ফিউচার'-এ এই তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, অধিকাংশ দেশে কোন খাবার কী পরিমাণ খাওয়া উচিত তার একটা নীতি আছে। সেই নীতি মেনে চলা উচিত। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের কর্তা জোয়াও ক্যাম্পারি বলেছেন, ''এই রিপোর্টে পরিষ্কার দেখানো হয়েছে, জি ২০ দেশের লোক যে খাবার খায় তা ঠিক নয়। যদি গোটা বিশ্বের লোক তাঁদের অনুসরণ করেন তা হলে আরও সাত দশমিক চারটি পৃথিবী দরকার হবে সেই খাবার যোগানের জন্য।''
ভবিষ্যতের খাবার কী হবে?
খাবার কেমন করে বদলেছে? কিংবা বদলে যেতে পারে আগামীতে? ছবিঘরে থাকছে সে কথা৷
ছবি: IzumiMiyazaki
চিনি বাদ
কোন ভোগ্যপণ্য বাতিলের প্রথম আন্দোলন হয় কবে জানেন? ১৭৯১ সালে৷ ‘দ্য সুগার বয়কট’ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোন ভোগ্য পণ্য বাতিলের আন্দোলন৷ কারণ চিনির সঙ্গে ব্রিটিশ দাস প্রথার সংযোগ ছিল৷ সে যাই হোক চিনি বাদ হয়নি৷ বরং নানা খাদ্যে মিশে আছে এখনো৷ তবে ভবিষ্যতেও হয়ত স্বাস্থ্যের কথা বিচার করে চিনি বাদ দেবার ডাক আসতে পারে৷
ছবি: The Trustees of the British Museum
সয়া সসেজের আবিষ্কার
যতই দিন গড়াচ্ছে নিরামিষ খাওয়া লোকের সংখ্যা বাড়ছে৷ তাই মাংসের বিকল্প হিসেবে নতুন নতুন খাবার যুক্ত হচ্ছে৷ কিন্তু এটা নতুন কিছু নয়৷ এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাওয়ার (তৎকালীন খাদ্য সরবরাহ বিভাগের পরিচালক) প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সয়া সসেজ আবিষ্কার করেন৷ বলা হয়ে থাকে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার৷
ছবি: Archiv der Stiftung Bundeskanzler-Adenauer-Haus
গ্রিনহাউজ টাওয়ার
১৯৬৪ সালে অস্ট্রিয়ান প্রকৌশলী ওথমার রুথনার ভিয়েনায় একটি প্রদর্শনীতে তার ‘টাওয়ার গ্রিনহাউজ’-এর আইডিয়া দেখান৷ ৪১ মিটার উঁচু কাঁচে ঘেরা তার গ্রিনহাউজে ফুল ও সবজির চাষ সম্ভব৷ এতে সেচ ও সারের ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়৷ পুরো বিশ্ব চমকে যায়৷ তাকেই ‘ভার্টিকাল ফার্মিং’-এর জনক মনে করা হয়৷
ছবি: Gartenbauschule Langenlois
সস্তা মুরগির আমদানি
যখন থেকে ইউরোপ ও মার্কিন খামারিরা সস্তায় আফ্রিকায় প্যাকেট করা মুরগির মাংস রপ্তানি শুরু করে, আফ্রিকার দেশ গানার পোলট্রি খামারিরা বিপদে পড়ে যান৷ স্থানীয় খামারিরা এখন মাত্র ৫% মুরগি বাজারে সরবরাহ করেন৷ তাই সেখানে দেশি মুরগি বিক্রি বাড়াতে এখন একটি ক্যাম্পেইন চালু রয়েছে৷
ছবি: Eat Ghana chicken
স্বচ্ছতা দরকার
মাংসের পাইকারি উৎপাদনের কারণে ভোক্তারা এখন বেশি ঝুঁকছেন প্রাকৃতিক বা ‘অরগ্যানিক’ খাবারে৷ অনেকেই এর প্রচারণাও চালাচ্ছে৷ যেমন ব্লক বার্ড নামের একটি কোম্পানির স্লোগান হল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে স্বচ্ছ মুরগির মাংস’৷ অর্থাৎ তারা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো থেকে শুরু করে দোকানে বিক্রির জন্য মুরগির মাংস পাঠানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ রেখেছে৷
ছবি: The Future Market
পানিতে খামার
পানিতেও খামার হচ্ছে আজকাল৷ যেমন নেদারল্যান্ডসের এই খামারটি ভাসমান৷ এতে জমিও বাঁচে৷ আবার এই খামারের গরুর দুধও সহজে পৌঁছে যায় ভোক্তাদের কাছে৷
ছবি: Floating Farm
ছয় পায়ের নাশতা
পোকামাকড়ও কিন্তু এখন নাশতার টেবিলে দেদারসে চলছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০১৮ সাল থেকে এসব পোকা খাওয়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Lothar Sprenger
চামচে স্বাদ
দক্ষিণ কোরীয় ডিজাইনার জিনহিউন জিয়নের চামচ খাবারের স্বাদ বাড়ায়৷ তিনি এর আকার, রং ও আরো কিছু বিষয় বদলে দেন যা মস্তিষ্কে এক রকমের অনুভূতিকে নাড়া দেয়, যার সঙ্গে স্বাদ যুক্ত৷
ছবি: Jinhyun Jeon
8 ছবি1 | 8
এ ক্ষেত্রে অপরাধী হলো ধনী দেশগুলি। তাদের দেশে একটা নীতি রয়েছে, কতটা খাবার খেলে পুষ্টি ঠিক থাকবে, বিশ্বও বাঁচবে। কিন্তু সেখানকার মানুষ তার থেকে অনেক বেশি খায় এবং নষ্ট করে। জি ২০ দেশগুলির মধ্যে আছে, বিশ্বের সব চেয়ে বড়, শিল্পোন্নত, প্রভাবশালী ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
প্যারিস পরিবেশ চুক্তির লক্ষ্য ছিল, বিশ্বের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস কম করা। এ জন্য খাবার সংক্রান্ত কার্বন নিঃসরণ কম করতে হবে। জি ২০ দেশগুলি ৭৫ শতাংশ খাবারজনিত কার্বন নিঃসরণ করছে।
শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, খাবার নষ্ট করার প্রবণতাও মারাত্মক। রিপোর্টের অন্যতম রচয়িতা ব্রেন্ট লোকেন বলেছেন, ধনী দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে খাবার নষ্ট হয়। করোনার ফলে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়েছে সেটাও মাথায় রাখতে হবে। লোকেন জানিয়েছেন, ''আমরা যে খাবার খাই এবং সেটা কীভাবে তৈরি হয়, তার ওপর কোভিড ১৯ এর মতো ভয়ঙ্কর ভাইরাস তৈরি হওয়া ও তাণ্ডব নির্ভর করে। স্বাস্থ্যকর, সুষম আহার করলে ভবিষ্যতে এই ধরনের মহামারির ঝুঁকি কমবে। এই মহামারি দেখিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কতটা ভেঙে পড়েছে।''
২০০ কোটি মানুষ বেশি খায়, ৮২ কোটি না খেয়ে থাকে
সারা বিশ্বে ধনী-গরিবের পার্থক্য বেড়েই চলেছে৷ দেশভেদে, অঞ্চলভেদে পার্থক্যটা অনেক বেড়ে যায়৷খাওয়া-দাওয়াতেও একই বৈষম্য৷কোটি কোটি মানুষ নিয়মিত খাবার পায় না, অনেকে আবার প্রচুর খাবার অপচয় করে ৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/AFP/R. Beck
৮২ কোটি মানুষ খাবার পায় না
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে অন্তত ৮২ কোটি মানুষ রাতে না খেয়েই ঘুমাতে যায়৷
ছবি: DW/R. Chakraborty
২০০ কোটি মানুষ বেশি খায়
এফএও-র প্রতিবেদনে ঠিক উল্টো চিত্রও উঠে এসেছে৷ দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ অতিরিক্ত খাবার খেয়ে খুব মোটা হয়ে গেছে৷
ছবি: AFP/GettyImages/M. Ralston
২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবারের অপচয়
যেখানে ৮২ কোটি মানুষ একবেলা কোনো খাবার পায় না, সেখানে সারা বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবার নষ্ট বা অপচয় করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Beck
কোথায় কত অপচয়
ইউরোপ এবং পূর্ব অ্যামেরিকার মানুষ গড়ে প্রতি বছর ৯৫ থেকে ১১৫ কিলোগ্রাম খাবার না খেয়ে ফেলে দেয়৷ সাব সাহারান আফ্রিকা এবং এশিয়া অঞ্চলে খাবার ফেলে দেয়ার প্রবণতা সেই তুলনায় অনেক কম৷ এই দুই অঞ্চলের মানুষ গড়ে প্রতি বছর ছয় থেকে ১১ কেজি খাবার ফেলে দেয়৷
ছবি: picture alliance / Food and Drink Photos
খাবারে ধনী-গরিব
উন্নত দেশগুলোতে বছরে মাথা পিছু খাবারের পরিমাণ ৯০০ কেজি, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে তা প্রায় অর্ধেক (৪৬০ কেজি)৷
ছবি: picture-alliance/AA/M. Hossam
5 ছবি1 | 5
তবে খাবারের ফলে কার্বন নিঃসরণের সব চেয়ে বড় কারণ হলো রেড মিট এবং দুধজাত জিনিস বেশি খাওয়া। রেড মিট বেশি খেলে সেই সব পশুপালন অনেক বেশি করতে হবে। চারণভূমি বেশি লাগবে। জঙ্গলের পরিমাণ কমবে। ফলে কার্বন নিঃসরণ বাড়বে। বাকি কার্বণ নিঃসরণ হয় বেশি করে রাসায়ণিক সার ব্যবহার, ধানের উৎপাদন বাড়ানো, কৃষি জমির পরিমাণ কম হওয়া এবং জঙ্গল কমে যাওয়ার কারণে। জি ২০ দেশে রেড মিট, দুধ ও দুধজাত জিনিস সব চেয়ে বেশি খান লোকেরা।
রিপোর্ট বলছে, অনেক দেশেই রেড মিট ও দুধজাত খাবার কতটা খাওয়া দরকার তার পরিমাপ আছে। জার্মানিতে যেমন দিনে খুব বেশি হলে ৫০ গ্রাম রেড মিট খাওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু খাওয়া হয় ১১০ গ্রাম। আর গোটা বিশ্বের জন্য যে নীতি, তাতে বলা হয়েছে, ২৮ গ্রামের বেশি রেড মিট যেন না খাওয়া হয়। জি ২০ দেশগুলির কারণে তাই কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। বিপদ বাড়ছে পৃথিবীর।