চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতির ফলে অনেক কঠিন রোগ-ব্যাধির নিরাময় সম্ভব হচ্ছে৷ তবে ধমনীর মধ্যে রক্তপিণ্ড দ্রুত মৃত্যুর কারণ হতে পারে৷ ডাক্তাররা এক প্রস্থেসিস বসিয়ে সেই বিপদ দূর করতে সক্ষম হয়েছেন৷
মানফ্রেড ইয়েগার-এর পেটে এক টাইম বোমা ছিল৷ কাকতালীয়ভাবে সেটা ধরা পড়ে৷ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞরা কয়েকদিন আগেই তাঁর পেটে একটি বস্তু নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন৷ ডাক্তারি পরিভাষায় সেটির নাম অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিসম৷ সেটি আসলে এক রক্তপিণ্ড, যা ধমনীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁর জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল৷ জার্মানির বন শহরে পেট্রুস হসপিটালের চিকিৎসক ড. ইয়ুর্গেন রেমিগ বলেন, ‘‘আমরা জানি, বেশ কয়েক বছর ধরে সমস্যা দানা বাঁধছিল৷ অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিসম বন্ধ করে আমরা তাঁর আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছি৷ তাঁকে কার্যত প্রাণে বাঁচিয়েছি৷''
অ্যানিউরিসম-এর আকার-আকৃতি এরকম দেখতে৷ ধমনীর মধ্যে রক্ত ফুলেফেঁপে ওঠে এবং বেলুনের মতো যে কোনো সময়ে ফেটে যেতে পারে৷ যেমন মানফ্রেড ইয়েগার-এর ক্ষেত্রে ধমনীর ব্যস দুই থেকে বেড়ে পাঁচ সেন্টিমিটার হয়ে উঠেছিল৷ মানফ্রেড ইয়েগার বলেন, ‘‘সত্যি, দেখলে মনে বিস্ময় জাগে৷ টেরও পাওয়া যায় না৷ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সমস্যা শনাক্ত না করলে আজ আর আমি বেঁচে থাকতাম না৷ নিঃশ্বাস নিতে বা হাঁটাচলা করতে আমার কোনো কষ্ট ছিল না৷''
দুর্বল হৃৎপিণ্ড চেনার ৫ লক্ষণ
আপনার কি মাঝেমধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়? কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অল্পতেই ক্লান্ত লাগে? হার্টের দুর্বলতার কারণেও এমনটা হতে পারে তা কি জানেন? আপনার হৃৎপিণ্ড কি দুর্বল? ছবিঘর দেখে জেনে নিন৷
হার্টের রক্ত ঠিকমতো চলাচল করতে না পারলে ফুসফুসের ভেতরে চাপের সৃষ্টি হয়৷ এর ফলে রোগীর শরীরে অক্সিজেন যাতায়াতে অসুবিধা হয়৷ এবং সে কারণেই শ্বাস নেওয়ার সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অন্যরকম শব্দ হয়৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সমস্যা
হার্ট যথেষ্ট রক্ত পাম্প করতে না পারলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও পেশী ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না৷ এ কারণে রোগী তাড়াতাড়ি ক্লান্ত বোধ করে এবং সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় কষ্ট হয়৷
ছবি: Colourbox
ধারণক্ষমতা কমে যায়
মস্তিষ্ক ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে না পারায় মনোযোগেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে৷ যাঁরা মস্তিষ্কেকের কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটার ব্যাপারটি ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়৷
রাতে টয়লেটে যাওয়া
অনেক সময় দুর্বল হৃৎপিণ্ডের রোগীদের শরীরের পানি সারাদিন ধীরে ধীরে পায়ে জমা হয়৷ রাতে বিছানায় শোওয়ার পর তা কিডনির মাধ্যমে বের হয়৷
দুর্বল হার্ট যথেষ্ট শক্তি দিয়ে রক্ত শরীরের নানা অঙ্গে পাম্প করে পাঠাতে পারে না বলে অনেক সময় তা পায়ে নেমে যায়৷ তাই তখন পা ফুলে যায়৷
ছবি: Colourbox
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
শ্বাস নিতে অসুবিধা হলে, সব সময় ক্লান্ত লাগলে এবং এ সবের পাশাপাশি পা ফুলে গেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত৷ সময় মতো রোগ নির্ণয় হলে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখা অসম্ভব নয়৷
ছবি: picture alliance/Godong/P. Deloche
জার্মানিতে অনেকেই ভুগছেন
হার্ট সঠিকভাবে পাম্প না করলে ধমনীতে রক্ত ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না৷ এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়৷ জার্মানিতে দুর্বল হার্টের মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ১৮ লাখ৷ দুর্বল হার্টের কারণে জার্মানির বিভিন্ন হাসপাতালে গত বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন মোট ৪ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ৷ জার্মানির ‘হ্যার্ৎসব্লাট’ ম্যাগাজিন এই তথ্য প্রকাশ করেছে৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
7 ছবি1 | 7
চিকিৎসক হিসেবে ড. রেমিগ বলেন, ‘‘ধমনী ফেটে গেলে এই রোগীরা রক্তক্ষরণের ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায়৷ আমরা জানি, বাসায় এমনটা ঘটলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ হাসপাতাল পৌঁছনো পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন না৷''
এক বিশেষ প্রস্থেসিস লাগিয়ে ডাক্তাররা সম্ভবত মানফ্রেড ইয়েগার-এর জীবন বাঁচাতে পেরেছেন৷ পেটের ধমনীর মধ্য দিয়ে সেটি ঠেলে প্রবেশ করিয়ে তাঁরা রক্ত চলাচলের গতিপথ বদলে দিতে পেরেছেন৷
রোগীর জন্য এই অপারেশন অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক হলেও ডাক্তারদের জন্য সেটি বড় এক চ্যালেঞ্জ৷ ড. রেমিগ বলেন, ‘‘সেই প্রস্থেসিস এমনভাবে স্থাপন করতে হয়, যাতে উপরে ও নীচে এক সুস্থ ধমনীর আবরণ থাকে৷ সেখানেই প্রস্থেসিস বসাতে হয়৷ তখন রক্তকে বাধ্য হয়ে প্রস্থেসিস-এর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে হয় – অ্যানিউরিসম থলেতে আর জমা হতে পারে না৷ ফলে তখন তার উপর চাপ দূর হয়৷''
রক্ত যে দুটি সরু চ্যানেলের মাধ্যমে ঠিকমতো চলাচল করছে, আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার মাধ্যমে তা শনাক্ত করা সম্ভব৷ মানফ্রেড ভেবার বিপদমুক্ত হয়েছেন৷ তবে ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে, কারণ তাঁর শরীরে ভাসকিউলার ওয়াল বা ধমনীর আবরণ সার্বিকভাবে দুর্বল৷ ফলে শরীরের অন্য কোনো অংশে আবার রক্তপিণ্ড সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে৷
সঠিকভাবে ব্লাডপ্রেশার মাপুন, চিন্তামুক্ত থাকুন
শরীরে রক্তচাপ বেড়ে গেলে ব্যথা না হওয়ায় অনেকেই তা জানতে বা বুঝতে পারেন না৷ তবে এমনটা বেশিদিন চললে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি এবং ধমনীর মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে৷ জেনে নিন ‘ব্লাড প্রেশার’ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য...
ছবি: Printemps / Fotolia
গোপন অসুখ
সাধারণত যাঁদের প্রেশার ‘লো’ তাঁদের চেয়ে, যাঁদের প্রেশার ‘হাই’ তাঁরা শারীরিকভাবে ভালো বোধ করেন৷ তাই অনেকে জানেনই না যে তাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে৷ তবে এমনটা বেশিদিন ধরে চললে তা হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি ও ধমনীর মারাত্বক ক্ষতি করতে পারে৷ বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস রয়েছে বা যাঁরা কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে বা অন্য কোনো কারণে প্রচণ্ড চাপে থাকেন, তাঁদের এই ক্ষতি এড়াতে প্রেশার মাপা উচিত৷
ছবি: Fotolia
সঠিক ফলাফল পেতে...
প্রেশার মাপার আধঘণ্টা আগে চা, কফি পান বা ভরপেট খাওয়া উচিত নয়৷ ধূমপান, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য৷ তাই উত্তেজনা এড়িয়ে প্রেশার মাপার পাঁচমিনিট আগে একটু শান্ত হয়ে বসুন৷ বাহুবন্ধনী যাতে বাহুতে সঠিকভাবে লাগানো যায়, সেই দিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে৷ তা না হলে রক্তচাপের ‘রিডিং’ যথার্থ হবে না৷ আর হ্যাঁ, মাপার সময় কোনো কথা নয়৷ একমাত্র তবেই যন্ত্রে সঠিক মাপটি ভেসে ওঠবে৷
ছবি: dpa
‘হাইপারটেনশন’ ও উচ্চ রক্তচাপ
রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০-এর মধ্যে হয়, তাহলে চিন্তার কারণ নেই৷ এর বেশি হলে তাকে ‘হাইপ্রেশার’ বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়৷ এ সমস্যা ধরা পড়লে, অন্তত সাতদিন সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত প্রেশার মেপে নোট করে রাখুন এবং প্রয়োজনে ২/১ মিনিটের ব্যবধানে ২-৩ বার করে মাপুন যাতে ডাক্তারকে জানানো যায়৷ কোনো উত্তেজনায় রক্তচাপ কিছুটা বাড়তে পারে, তবে নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ থাকা কোনো কঠিন রোগের লক্ষণ হতে পারে৷ডাক্তারের পরামর্শ নিন৷
ছবি: Fotolia/fotografci
ছুটিতে গেলেও মাপা চাই...
ছুটিতে গেলেও নিয়মিত ব্লাডপ্রেশার মাপা উচিত৷ যেহেতু ছুটিতে মানুষ অন্য মেজাজে এবং বিশ্রামে থাকে, সে সময়ে ভালোভাবে বোঝা যায় যে, এই উচ্চ রক্তচাপ দৈনন্দিন চাপের কারণে হচ্ছে না এর পেছনে অন্য কোনো অসুখ লুকিয়ে রয়েছে৷ তাই উচ্চ রক্তচাপের আসল কারণ খুঁজে বের করতে অবশ্যই নিয়ম মেনে ছুটির মধ্যে বা বেড়াতে গেলেও নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন৷ আজকাল কিন্তু প্রেশার মাপার নানারকম আধুনিক এবং ‘হ্যান্ডি’ যন্ত্র বেরিয়ে গেছে!
ছবি: picture-alliance/dpa/Prismaarchivo
তরুণদের ক্ষেত্রে
যাঁরা প্রতিনিয়ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন বা যাঁদের ওজন বেশি কিংবা পরিবারে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারুর উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তাঁরাও কিন্তু কোনোরকম অসুবিধা না হলেও মাঝে-মধ্যে প্রেশার মাপুন৷ একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, জার্মানিতে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে ব্লাডপ্রেশার রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে৷ অবশ্য এর প্রধান কারণ হিসেবে শরীরের বাড়তি ওজনকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: DW/Marina Estarque
‘ইমারজেন্সি’
নিয়মিত দিনের বিভিন্ন সময়ে প্রেশার মাপার পর, উচ্চ রক্তচাপ থাকার পাশাপাশি যদি বুক জ্বালা, ব্যথা বা বুকে চাপ, নিঃশ্বাস নিতে এবং কথা বলতে কষ্ট বা অসুবিধা হওয়া, বমিভাব, নাক দিয়ে রক্তপড়া – এ ধরনের লক্ষণও দেখা দেয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে৷ উচ্চ রক্তচাপকে হাল্কা করে নেয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়!
ছবি: Colourbox/E. Wodicka
সচেতনতা
উচ্চ রক্তচাপ যেন না হয় বা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে জন্য প্রয়োজন সচেতনতা৷পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি,ই, ও আঁশযুক্ত খাবার এ সমস্যাকে দূরে রাখতে সাহায্য করে৷ যা সূর্যমুখী ফুলের বিচি, সীমের বিচি, পুঁইশাক, তরমুজ, কলা ইত্যাদি খাবারে রয়েছে৷ হাই ব্লাডপ্রেশারকে জয় করতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন প্রয়োজন৷ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে কোনো চিন্তা নয়, কারণ চিন্তাই রক্তচাপকে আরো বাড়িয়ে দেয়!
ছবি: Printemps / Fotolia
7 ছবি1 | 7
ডাক্তাররা তাঁর শরীরে অ্যানিউরিসম শনাক্ত করে দূর করায় মানফ্রেড ভেবার অত্যন্ত খুশি৷ মানফ্রেড বলেন, ‘‘সবকিছু ভালভাবেই হয়েছে৷ ফলে আমি বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছি৷ জীবনমরণের সমস্যা ছিল৷''
পেটের ধমনীর রুটিন পরীক্ষা করা হয় না৷ মানফ্রেড ইয়েগারকে অবশ্য ভবিষ্যতে নিয়মিতভাবে এই পরীক্ষা করাতে হবে৷